শনিবার, ৮ জুন, ২০১৩

সাভার ট্রাজেডি এবং কিছু অভিজ্ঞতা!

উখিয়াতে যাওয়ার পর টিভি দেখা ও পেপার পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কিন্তু তারপরেও ঘটনার রাতেই খবর পেলাম সাভারে বিল্ডিং ধসের কথা। পাশের ঘর থেকে সেন্সেশনাল এই নিউজ দেখার জন্য ডাকাডাকি শুরু হলো। আমি কয়েকটা দৃশ্য দেখে নিজের রুমে ফিরে এলাম। এবং মাথা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক মাঝেমধ্যেই সাভারেসের  দু একটা বিল্ডিং ধসের ঘটনা ঘটবে, মানুষ মারা যাবে, অনেক আলোচনা হবে, পত্রিকায় লেখালেখি হবে, তারপর আবারো আরেকটি ঘটনা ঘটবে! ব্যাক্তিগতভাবে এতো আবেগপ্রবণ হওয়ার কিছু নাই। যুক্তি মস্তিস্ক বুঝলেও মন বোঝেনা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া শুরু হলো। আমার সমস্যা এইটাই, করার কিছুই থাকে না কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়ার কষ্ট সহ বিভিন্ন লক্ষণ শুরু হয়। কিন্তু এইবার ঘটনার পরদিন ছুটির দিনে অফিস থেকে ফোন পেলাম যে সাভারের দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমার জন্য কি এই ছুটির সময়ে যাওয়া সম্ভব কিনা। কি বলে? আমি প্রতিটি মুহূর্তে কত কত বার ভাবছি, ইশ যদি আমি ঢাকায় থাকতাম! হয়তো ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করতে পারতাম! পরদিনই অফিসের পক্ষ থেকে ঢাকায় চলে আসলাম সাভার ভিক্টিমদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য। লোকবল বাড়ানোর জন্য প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবার (Psychological First Aid, PFA) প্রশিক্ষণ দিয়ে নিলাম। তারপর ১২ জনের একটি দল নিয়ে এনাম মেডিক্যাল কলেজে পৌছে গেলাম। কলেজটির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগীতা পেয়েছি। কিন্তু যে বিষয়টি কাজের অসুবিধা করেছে তা হলো হাসপাতালটিতে সকলের অবাধ আনাগোনা। কেউ কয়েকটা বিস্কুট, লুঙ্গি-শাড়ী নিয়ে, কেউ ডোনেশন নিয়ে, কেউ বা শুধু এলাকার বা নিজের অঞ্চলের লোকদের জন্য ডোনেশন নিয়ে! কেউ কেউ ভিজিট করার জন্য, আবার একটি স্কুল থেকে আসা বাচ্চাদেরও দেখা গেল!!! দেখা গেল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য লাইনে দাড়াতে হচ্ছে! আমার এক্সপাট বস পরিস্থিতি দেখে খুবই বিরক্ত। তাই দুইদিনে কাজ শেষ করেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আমার অর্গানাইজেশনের যেহেতু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল তাই আমি রয়ে গেলাম।

দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে যাদের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল সেই প্রতিটি নাম্বারে ফোন করে তাদের মানসিক অবস্থার খোঁজ খবর নেয়া হয়েছিলো যেন এই প্রাথমিক মিডিয়ার ধাক্কা কাটার পর তাদের যখন আসলেই তাদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে তার একটা পরিকল্পনা করা যায়। আমি নিজেই উপযাচক হয়ে প্রায় একশোর মতো ফোন করেছি যেন দুর্ঘটনা পরবর্তী মান্নসিক সমস্যা কি ধরনের হতে পারে তা ভালো করে উপস্থাপন করতে পারি। তারপর পরিকল্পনাকালীন সময়ে আবার নিজ কাজের ক্ষেত্র উখিয়াতে ফিরে গেলাম।

সপ্তাহখানেক পরই আবার ঢাকায় দ্বিতীয় দফা কাজ শুরু করার জন্য। সাথে কানাডিয়ান মেন্টাল হেলথ অফিসার। তিনি শুধু যেন একক ভাবেই না গ্রুপেও ভিকটিমদের সাপোর্ট দিতে পারি সে বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিলেন। এর পাশাপাশি ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির স্টুডেন্টদের ধন্যবাদ পাওনা যারা এই ধাপে আমাকে সহায়তা করেছে। তাদের অদম্য ইচ্ছাই পরীক্ষা মাথায় নিয়েও তারা এই মহৎ একটি কাজে সম্পৃক্ত হতে উদবুদ্ধ করেছে!

দ্বিতীয় আমার কাজ ছিলো মূলতঃ কাজটিকে শুরু করিয়ে দেয়া। প্রথম গ্রুপ করে আশানূরুপ ফলাফল পাওয়ার পর আবার আমার নিজ কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সময় হলো। কাজ চলছে, প্রয়োজন সাপেক্ষে চলতে থাকবে।

এই কাজ চলাকালীন সময়েও অনেক সময় মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে, বুক ভার হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভালো লাগার বিষয় একটাই ছিলো যে আমি কিছু করতে পারছি। ভালো লাগার আরো একটা বিষয় ছিলো যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা আমরা অনেক ভালো করেই ম্যানেজ করতে পেরেছি যদি আরো একটু গুছিয়ে, সমন্বয় করে করতে পারতাম। আর যেন এরকম না ঘটে সেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যদি গ্রহণ করা হতো!!!