মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

ডিজিটালাইজেশনের মনোসামাজিক প্রভাব



সারা বিশ্বজুড়েই নিত্যনতুন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের কদর রয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার লক্ষ্যে , যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ থেকে সহজতর করার উদ্দ্যেশ্যে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের উদ্ভাবন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। একটি মডেল বাজারে আসার পরপরই আবার তার নতুন মডেল বাজারে চলে আসছে। আমরা সবাই সেই নতুন মডেলের পণ্য ক্রয় করে নিজেকে আধুনিক বা আপডেট করে রাখছি।
প্রযুক্তির এই ব্যবহার শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমাদের বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী পদক্ষেপ। প্রতিটি স্কুলে ছাত্রদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা হাতের নাগালে নিয়ে আসা হচ্ছে, মোবাইলের সিম ফ্রি দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও নানান পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্যকিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বা আমাদের সমাজে তার কিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কি আমরা খেয়াল করছি??
আমাদের ওয়াই জেনারেশন এখন ডিজিটাল জীবন যাপন করে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা তাদের নেটওয়ার্ক এখন অনেক বিস্তৃতকিন্তু এখানেও সেই কিন্তু রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমাদের সোশ্যালাইজেশনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না কি আমাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে আমরা আমাদের বেশীরভাগ সময় এখন ভার্চুয়াল জগতেই কাটাই, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। একটি গবেষনায় দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের উদ্বেগে আক্রান্ত করে। সদ্য আপলোড করা ছবিতে কয়টা লাইক পড়ল, কে কি মন্তব্য করল এইসব বিষয়ে ব্যবহারকারীরা উদ্বেগে ভোগেন। মানসিক রোগ সনাক্তকরণে যে মানদন্ডগুলো ব্যবহার করা হয় ডি এস এম (diagnostic and statistical manual)  তার মধ্যে অন্যতমডি এস এম-এর পঞ্চম সংস্করণে ইন্টারনেট এডিকশন, ঘন ঘন সেলফি তোলা ইতিমধ্যেই মানসিক সমস্যা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
মানসিক রোগ বা সমস্যা তৈরী করা ছাড়াও আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে কিরকম প্রভাব পড়ছে তা যদি আমরা খেয়াল করি। আমরা এখন প্রতিনিয়তই প্রতিযোগীতার ভেতর পড়ে যাচ্ছি, অসুস্থ প্রতিযোগীতা। আমাদের এখন স্কুল বয়সী বাচ্চাদের মোবাইল, ল্যাপটপ দরকার হয়। না হলে তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে, সেই ভয়ে বাবা মাও কিনে দেন। কথা হচ্ছে এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। এই মোবাইল, ল্যাপটপগুলোর আজকে এক মডেল বের হলে কালকে তা পুরানো হয়ে যায়। নতুন মডেলে নতুন নতুন ফিচার যোগ হয়। ফলে পুরানোগুলোর আর আকর্ষণ থাকে না। তাই আবার নতুন মডেল কেনার তাড়না কাজ করে। যাদের টাকা পয়সা আছে কিন্তু সময় নাই তারা সন্তানদের জিনিসপত্র দিয়ে ঠান্ডা রাখেন, যাদের টাকা পয়সা নাই তারা সন্তানদের আবদারে বিব্রত বোধ করেন। পরিবারে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। বাবা মা হন ব্যাকডেটেড যারা নতুন জেনারেশনের চাহিদা বোঝেন না। পরিবারগুলো এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রত্যেকেই নিজেদের মতো ব্যস্ত, মোবাইল বা ফেসবুক নিয়ে। কারো কারো অস্থিরতা এতো চোখে পড়ার মতো যে তারা এক মুহূর্ত মোবাইল ছাড়া থাকতে পারেন না। কিছু না হলে অকারণেই মোবাইল টিপাটিপি করতে থাকেন। একজন তরুণের সাথে কথা হয়েছিল যার ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ১৬০০ কিন্তু তার কমপ্লেইন ছিলো একা একা লাগে, তাকে কেউ ভালোবাসে না। পত্রিকায় পড়েছিলাম আইফোন-৬ কেনার জন্য একজন তার গার্লফ্রেন্ডকে বিক্রি করে  দিয়েছেন। অফিসে ফেসবুক ব্যবহারের জন্য অনেকেই চাকুরী হারাচ্ছেন, ভাঙছে বৈবাহিক সম্পর্কও। পর্ণোগ্রাফীর মাত্রা বেড়েছে আতঙ্কজনকভাবে, আজকে এর ভিডিও প্রকাশ পাচ্ছে তো কালকে তার ভিডিওস্কুলের ছোট ছোট মেয়েদেরও রেহাই নেই!!!
এই উদাহরণগুলো পড়ে হয়তো অনেকেই বলবেন এখানে শুধু প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোকেই তুলে ধরা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যাবহারের অসংখ্য ইতিবাচক দিক আছে যা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু যে নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে তাও ফেলে দেবার মতো নয়। প্রযুক্তির পরিমিত ব্যবহার নেতিবাচক দিকগুলোকে অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে পারে। শুধু তাই নয় আমরা প্রতিদিনই যদি নিজেকে কিছুটা সময় দেই, খেয়াল করার জন্য যে আজকের দিনটা কিভাবে ব্যায় করলাম তাহলে হয়তো লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছি কিনা। যা ভালো লাগে শুধু তাই করার দিকে না ঝুঁকে যেটুকু প্রয়োজন সেই সীমা নির্ধারণ করে তা মেনে চলাটাই কঠিন। সারাক্ষণ মোবাইল টিপাটিপি না করে, ইন্টারনেটের জগতে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় না করে যদি পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটাই তা আমাদের মনের জগতকে বেশী স্থিতিশীল করে। কোথাও বেড়াতে বা খেতে যাওয়ার উদ্দেশ্য যেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া না হয়। যখন যেখানে সময় কাটাই তা যেন উপভোগ করতে পারি। মোবাইলে ব্যালেন্স বা মেগাবাইট শেষ হয়ে গেলে তা যেন আমাদের উদ্বেগে আক্রান্ত না করে। সবাই যে গতিতে ছুটছে সেই গতিতে ছোটার তাড়না যেন আমাদের সারাক্ষণ অসুখী করে না রাখে।
প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা এমন একটা সময় দিয়ে যাচ্ছি এইরকম উদ্দেশ্য থাকলে তা শুধু উইশফুল থিঙ্কিং হিসাবেই রয়ে যাবে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার আমরা কমিয়ে আনতে পারি। নিজেরা সচেতন হলে, নিজেদের পরিবারে, সমাজে একটু সচেতন ভূমিকা রাখলে সবাই মিলে হয়তো  এই অপব্যবহার প্রতিরোধ করা সম্ভব।

শনিবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৪

ভালোবাসতেই যত ভয়



মাইশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে চাকুরীজীবনে প্রবেশ করেছে। বয়স ২৭, দেখতে চলনসই। কিন্তু এখনও একা। ভালোলাগেনি কখনও কাউকে তেমন নয়, ভালোলাগার কথা বলা হয়নি। ভালোলাগার কথা বলেনি যে কেউ তেমনও নয়, ভালোবাসার সম্পর্কে নিজেকে জড়ানো হয়নি। পড়শোনায় বুদ্ধিমতি, লক্ষ্মী, বাধ্যগত মেয়ে হিসাবে মাইশার পরিবারে সুনাম আছে। সেই সুনাম ধরে রাখার জন্য সবসময়ই একটা মানসিক চাপ বোধ করে। মাইশার ছোটবেলাতেই তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়। মাইশা তার মার সাথে নানাবাড়ী থাকে। লক্ষ্মী মেয়ে হিসাবে সুনাম ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার সেটাও একটা কারণ। মাইশার কেবলই মনে তার যে কোন ভুলকেই তার বাবা মার ডিভোর্সের ব্যাপারটিকে তুলে ধরবে, যে বাবা মা আলাদা থাকে বলে ছেলেমেয়ে ঠিকমতো মানুষ হয়নি! তাই ভুল করার ঝুঁকি মাইশা কখনই নিতে চায়না। কাউকে ভালো লাগলে, কোন সম্পর্কে জড়ালে তার ফলাফল কেমন হবে তার হিসাবটা অংকের মতো সুনির্দিষ্ট নয় বলে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে চায়না। কখনও একা লাগেনা তা না, অস্থির লাগেনা তা না, কখনো যে মনে হয়না যে পৃথিবীতে কেউ তাকে ভালোবাসেনা তাও না, কিন্তু এই অনুভূতিগুলোর কথা মাইশা কাউকে বলতে পারেনা। কাউকে ভালবাসলে হয়তো আরো বেশী কষ্ট পেতে পারে, ভালোবাসার মানুষ তাকে ছেড়েও চলে যেতে পারে এই ভয়ে মাইশা যে কোন সম্পর্কের হাতছানি থেকেই দূরে সরিয়ে নেয়। চাকুরী, ক্যারিয়ারের দিকে মনযোগী হয়। তাই অন্যদের চোখে মাইশা অ্যাম্বিশাস ও প্রাক্টিক্যাল একজন মানুষ। যার ফলে ভালো লাগার কথা বলা মানুষদের সংখ্যাও কমে যেতে থাকে, মাইশা আরো বেশী একা হয়ে যেতে থাকে।”

হয়তো খুব বেশী নয় কিন্তু মাইশার মতো অনেকেই আছেন যারা ভালোবাসতে ভয় পান। আমার এই অল্প দিনের অভিজ্ঞতাতেই এইটুকু দেখার সুযোগ হয়েছে যে আবেগীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগের সহজ বহিঃপ্রকাশ আসলে কতটা কঠিন!

কোথাও পড়েছিলাম দেশের জনগণকে ভালোবাসা সহজ কিন্তু প্রতিবেশীকে ভালোবাসা কঠিন! তার মানে হচ্ছে অনেক মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা সহজ হলেও নির্দিষ্ট কারো প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা প্রকাশ করা কঠিন। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনেক রকম হিসেব নিকেশ কাজ করে। অনেকেই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে অনুভূতির কথা প্রকাশ করতেই ভয় পান, আবার অনেকেই আছেন যারা সম্পর্কের ভেতরেও নিয়ন্ত্রণ হারাবার আতংকে থাকেন। তারা ভালোবাসতে ভয় পান। মনে করেন সঙ্গী যদি বুঝে ফেলে যে তিনি বেশী দুর্বল তার প্রতি তাহলে হয়তো বেশী সুযোগ নিবে বা কোন কারণে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে অনেক বেশী কষ্ট পাবেন! এই ভয় শুধু বিয়ের আগেই নয় বিয়ের পরেও অনেক দম্পতির ভিতরে কাজ করে। একবার এক ক্লায়েন্ট আমাকে তার স্ত্রী সম্পর্কে বলছিলেন। যখন আমি তার কাছে জানতে চাইলাম তিনি তার অনুভূতির কথা তার স্ত্রীকে বলেছেন কিনা। তখন তিনি বললেন “না বলি নাই। বললে তো বুঝে যাবে যে ওরে ছাড়া আমি থাকতে পারবনা। তখন নিজের জিদ বেশী রাখব, আমার কথা শুনতে চাইবনা”।

কেউ কেউ আবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে ভয় পান। তার পেছনেও অনেক সময় পরবর্তীতে কষ্ট পাওয়ার ভয় বা ভালোবাসলে বেশী ভালোবাসার ভয় কাজ করে। কেউ কেউ হয়তো একবার কষ্ট পেয়েছেন সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এরপর আর কাউকে মন দিয়ে ভালোবাসবেন না! বা তেমন সিরিয়াসলি সম্পর্কে জড়াবেন না! সেক্ষেত্রে এই জাতীয় কথাগুলো খুব বেশী শোনা যায়- 

“সত্যিকার ভালোবাসছিলাম, বুঝলনা। চলে গেল। তখন থেকেই ঠিক করছি আর কাউকে সিরিয়াসলি ভালোবাসব না। ধরব আর ছাড়ব”। বা
“ছেলেদেরকে বিশ্বাস করা বোকামী, ওদের মন মুহুর্তেই ঘুরে যায়। প্রেম করলে অসুবিধা নাই, বিয়ে বাবা মার পছন্দে করাই ভালো”

তাই অনেকই সাবধানতা বজায় রেখে (Safety behavior) ভালোবাসতে পছন্দ করেন। যেন সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও মনে বেশী কষ্ট না পান। মজার ব্যাপার হল এই সাবধানতাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভাঙ্গার অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। কারণ এই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই অনেকে সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব বজায় রাখেন, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে যায়। সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব নিজের কাছে রাখতে চান কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি ইনভলভ করতে চান না। যার ফলে ছোটখাট কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব এতো বেশী হয়ে যায় যে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায়! তখন তারা আত্মতৃপ্তিতে ভুগেন যে ভাগ্য ভালো তেমন বেশী ভালোবাসেন নি, না হলে তো এখন ভীষণ কষ্ট পেতেন!

ভালোবাসা নিয়ে ভালো ভালো উপদেশ দেয়া বা লাভ গুরু হওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। ভালোবাসতে ভয় পাওয়া –অদ্ভুত এই সমস্যাটিকে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি, অনেকের মাঝে দেখেছি। সমরেশ মজুমদারের একটা বই পড়েছিলাম ‘অনেকেই একা’। গল্পটা ভালো লাগেনি কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর এই যুগে নামটাকে এখন অনেক যথার্থ মনে হয়। ফ্রেন্ড লিস্টে অনেক অনেক বন্ধু নিয়ে এখন অনেকেই একা! তারা ভালোবাসতে ভয় পান, ভালোবাসা গ্রহণ করতে ভয় পান, কেউ ভালোবাসলে সন্দেহ প্রকাশ করেন, পিছনে রহস্য কি জানতে চান। সাঁতার কাটতে নেমে জলে গা না ভেজানোর মতো ভালোবেসে তার কষ্ট পাওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চান। কিন্তু নিরাপদ আচরণগুলো সাময়িক স্বস্তি দেয় বটে, কোন সমস্যার সমাধান দেয়না। তাই নিজেকে কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখার বা সম্পর্কের কর্তৃত্ব ধরে রাখবার প্রবণতা সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল করে শুধুমাত্র, এর বেশী কোন কাজে আসেনা। এই মন্তব্য আমার পর্যবেক্ষণ থেকে করা। আপনাদের যে কোন মতামত জানানোর আমন্ত্রণ রইল।

শনিবার, ১৮ জানুয়ারী, ২০১৪

প্যারিস ঘুরে এলাম (শেষ পর্ব)



হোস্টেলে এসে ফ্রেশ হতে হতে বাইরে তখন আঁধার নেমে গেছে। অপরিচিত শহরে সন্ধ্যার পর বাইরে বের না হওয়ারই সিদ্ধান্ত নিলাম। কিন্তু ঘুমিয়ে পরবার জন্যও তা আবার অনেক তাড়াতাড়ি। স্কাইপে বাসায় কথা বলে নিচে নামলাম। ইচ্ছা ছিল একটু সোশ্যালাইজ হওয়ার। কিন্তু দেখলাম সবাই নিজের ভেতরেই ডুবে আছে। এগমন্ডে যেহেতু আমরা নিজেরাই সবাই ছিলাম। তখন বিষয়টা খেয়াল করিনি। রিশিপশনিস্টকেও দেখলাম খুব ব্যস্ত। প্রায় আমার বয়সী আরেকটি মেয়ে চেক ইন করছে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম যদি মেয়েটি আমার দিকে তাকায়, যদি একটু কথা বলা যায়। সেরকম কিছু হলনা। মেয়েটি তার জিনিসপত্র বুঝে নিয়ে উপরে উঠে গেল। আমি রিসিপশনিস্টের দিকে এগিয়ে গেলাম।
“আমি দুইদিন প্যারিসে আছি, আইফেল টাওয়ার আর লুভর মিউজিয়াম দেখার ইচ্ছে আছে, কিভাবে যাব, আর কোথায় কোথায় যেতে পারি আপনি কি একটু বলে দিতে পারবেন?” রিসিপশনিস্ট সাথে সাথে ম্যাপ নিয়ে প্যারিসের দর্শনীয় স্থানগুলো দাগ দিয়ে দেখাতে লাগল। কিভাবে যাব তাও বলে দিচ্ছিল কিন্তু মাথায় কিছু ঢুকেছে বলে মনে হয়নি। চার পাঁচটা টুরিস্ট স্পট দেখানোর পর বলল “ এগুলো কালকে দেখে আসেন, আমি কালকে রাতেও এখানে আছি, এরপরে না হয় আবার কথা বলা যাবে”। আমিতো একদিনে এতগুলো জায়গাতে ঘোরা যাবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছিলাম, রিসিপশনিস্টের কথা তা নির্ভর করছে আমি কতখানি সময় নিয়ে ঘুরতে চাই তার উপর!

সকালবেলা আলসেমিতে বিছানা ছেড়ে উঠতে ইচ্ছা করছিলনা। কিন্তু ব্রেকফাস্টের সময় সকাল দশটা পর্যন্ত। ব্রাজিলিয়ান রুমমেট একসাথে নাস্তার জন্য ডাকল। আমি আসছি বলে তাকে যেতে বললাম। সকালের সবকাজ সেরে একাবারে প্রস্তুত হয়ে নিচে নামতে নামতে আমার রুমমেট নাস্তা সেরে চলে এসেছে। আমি বিব্রতভঙ্গীতে হাসি দিয়ে রুম থেকে বের হলামমাথায় তখনো সারাদিন কিভাবে কাটাব তা নিয়ে চাপ কাজ করছিলো। আগের দিনের অভিজ্ঞতাই আরো বেশি চাপ সৃষ্টি করছিলো, এখানে ডিরেকশন জানতে চাওয়া কঠিন হবে। অথচ আমার প্রতিনিয়তই তা দরকার পড়বে। নাস্তা করতে করতেই দেখি একজন ভদ্রলোক রিসিপশনে ম্যাপ দেখিয়ে কিছু জানতে চাইছেন। ভদলোককে দেখে এশিয়ান মনে হলো। আমি দ্রুত নাস্তা শেষ করে এগিয়ে গেলাম। ততক্ষনে তিনি দরজার বাইরে।  একটু জোরে পা চালিয়ে কাছে পৌছে গেলাম “ হাই, আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, আপনি কি এখন কোথাও বেড়াতে যাচ্ছেন?” “হ্যাঁ, লুভর মিউজিয়ামে” তিনি বললেন। “আমি এখানে একা বেড়াতে এসেছি, এখানে তো কেউ তেমন ইংরেজি বলেনা তাই একটু সমস্যা হচ্ছে। আমিও লুভর মিউজিয়াম দেখতে যাব। আমি আপনার সাথে আসি?” অনুরোধটি করার আগ মূহুর্ত পর্যন্ত আমি জানতামনা আমি এই জাতীয় হাস্যকর অনুরোধ করতে পারি! আমার যে সোশ্যাল এংজাইটি আছে শুধু সে কারণে নয়, অনেকেই বলে আমি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখতে পছন্দ করি, সেটাও একটা বিশাল কারণ। ভদ্রলোককে একটু দ্বিধান্বিত মনে হলো, তারপরও সঙ্গে নিলেন। জানতে চাইলেন আমি সরাসরি বাংলাদেশ থেকেই এসেছি কিনা। সেই সুযোগেই আমি আমার সাইকোলজিস্ট পরিচয়টা দিয়ে দিলাম, আমস্টারডাম থেকে ট্রেনিং শেষ করে এখানে এসেছি বললাম, তার দামি জিনিসপত্র নিয়ে যে আমি পালাবনা সে বিষয়ে আশ্বস্ত করার জন্য! ভদ্রলোক ইন্ডিয়ান, কর্মসূত্রে জার্মানী এসেছিলেন, সেখান থেকে উইকেন্ডে বেড়াতে প্যারিস এসেছেন। সেদিন বিকেলেই পাঁচটার ট্রেনে আবার জার্মানী চলে যাবেন আমি তখন অনেকটাই রিলাক্সড। বাস স্টপ, বাস, কোথায় নামব তা নিয়ে আর চিন্তা করতে হচ্ছেনা। উনি আগেরদিনও  ঘোরাঘুরি করেছেন, তাই কিছুটা অভিজ্ঞ মনে হলো। উনার পরামর্শ অনুযায়ী বাসের পাস করে নিলাম, যার ফলে যাতায়াত খরচ অনেক কমে গিয়েছিল।

ভদ্রলোককে আইফেল টাওয়ার, মোনালিসা সম্পর্কে বেশ অবসেসড মনে হলো। আগ্রহ আমারও আছে, সেকারণেই প্যারিস আসা, কিন্তু উনার কথা শুনে মনে হলো ঠিক অতটা হয়তো আমার নেই। লুভর মিউজিয়ামে পৌছানোর পর উনার প্রথম কথা হলো “আগে মোনালিসা দেখে নেই”! পুরো লুভর মিউজিয়ামটা দেখার মতো করে দেখতে গেলে মাসখানেক লেগে যাওয়ার কথা। আমরা শুধু মোনালিসার অনুসন্ধান করতে করতে অন্যান্য পেইন্টিং গুলো দেখে গেলাম। আমার কাছে পেইন্টিং হচ্ছে কবিতার মতো, কবিতা যেমন উপন্যাসের মতো পড়ে শেষ করে ফেলা যায়না সেরকম। আমাদের সাথে কোন গাইড নেই, লেখাগুলো সব ফ্রেঞ্চ ভাষায়, তাই পেইন্টিং গুলো শুধু দেখতে কেমন তাই দেখলাম, মর্মার্থ বুঝলাম না! গাঁগাঁর কিছু ত্রিমাত্রিক ছবি লেখলাম। একটা প্লেটের উপর একজন পুরুষের কাটা মাথা রেখে দেয়া! ভালো করে খেয়াল করলে দেখা যায় কাটা মাথা ধীরে ধীরে চোখ খুলছে। এই জাতীয় ছবি সেই রুমে অনেকগুলো। ঘরের মাঝখানে বিশাল একটি পেইন্টিং-এ একটি মেয়ে মলিন মুখে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ সময় দিয়ে দেখলে দেখা যায় তার চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ছে। কিন্তু আমি অবাক হয়ে গেলাম যখন দেখলাম একটি পাখি উড়তে উড়তে ক্যানভাস থেকে বের হয়ে গেল! ছবিটির বিপরীত দিকে তাকিয়ে দেখলাম সেখানে প্রজেক্টর লাগানো। প্রজেক্টর দেখে বিস্ময়ভাব দূর হয়ে গেল। এই ছবিগুলো এতো বিখ্যাত কেন জানতে ইচ্ছা করল, কিন্তু বলে দেয়ার মতো কেউ ছিলনা। মোনালিসাকে খুঁজে পেতে সময় লাগছিল, আমার সাথের ভদ্রলোক অস্থির হয়ে যাচ্ছিলেন। যেহেতু উনার অনুমতি না নিয়েই উনার সম্পর্কে লিখছি, তাই একটা নাম ধরে নেই, ধরে নেই রাহুল (হিন্দী ছবির নায়কদের সবচেয়ে কমন নাম! ভদলোকের আসল নামও বলিউডের নায়কের নাম, তাই বিষয়টা খুব বেশী সিনেমাটিক হলনা) মোনালিসা খুঁজতে খুঁজতে মজার পরিস্থিতি তৈরি হলো। জিজ্ঞেস করে করে যাওয়া সত্ত্বেও এমন জায়গায় পৌছালাম যে মানুষজন দেখতে পাচ্ছিলাম না। মিউজিয়ামটাও এমন কোন দরজার পেছনে কি অনুমান করা কঠিন। তো রাহুল কাউকে না পেয়ে এক দরজার নব ধরে ধাক্কা দিলেন। সাথে সাথেই দরজা খুলে মিউজিয়াম অথরিটির এক ভদ্রলোক বের হয়ে এলেন। রাহুল তাড়াতাড়ি বলে উঠলেন “we are looking for Monalisa”. “She is not here” ভদ্রলোক তড়িৎ জবাব দিলেনপেছন থেকে আমি হেসে উঠলাম। ফ্রেঞ্চদের সেন্স অব হিউমারের সাথে প্রথম পরিচয়। তিনি আমাদের দেখিয়ে দিলেন যাদুঘরের কোন অংশে আমরা মোনালিসাকে দেখতে পাব। দেখলাম শুধু আমরাই নই অন্যেরাও মোনালিসা দেখতেই আগ্রহী। যার ফলে যাদুঘরের অন্যান্য অংশে মানুষজন তেমন দেখা না গেলেও মোনালিসা দেখার জন্য ভীড় ঠেলে এগুতে হলো।  মোনালিসা দেখে রাহুল সাহেবের মতো উচ্ছসিত না হলেও কিছুটা অবিশ্বাস্যই মনে হচ্ছিল যে আমি এখন প্যারিসের লুভর মিউজিয়ামে মোনালিসার সামনে দাঁড়িয়ে। পুরো একটি বিশাল দেওয়াল জুড়ে ছোট্ট মোনালিসাটি বসানো। তারপর ফোটসেশন শেষ করে অন্যান্য পেইন্টিংগুলোর দিকে মনযোগ দিলাম। মোনালিসার বিপরীত দিকের পুরো দেয়াল জুড়েই বিশাল এক পেইন্টিং! আয়তনের দিক থেকে বিখ্যাত হওয়া গেলে এটারই সবচেয়ে বিখ্যাত হওয়ার কথা। এতো বিশাল পেইন্টিং লিওনার্দো কিভাবে আঁকলেন তা চিন্তা করেই বিস্ময় জাগে! এরপরে আরো বেশ কিছু পেইন্টিং দেখা হলো, অবশ্যই বিখ্যাত সব চিত্রকর্ম কিন্তু অজ্ঞতার কারণে তার মূল্যায়ন ভালো করে করতে পারলামনা!

লুভর থেকে বের হয়ে আমরা হাঁটতে হাঁটতে নটরডেমের দিকে রওয়ানা দিলাম। সেখানে ৮০০ বছরের পুরানো গীর্জা অপেক্ষা করছে। গীর্জায় পৌছাতে পৌছাতে পথভুল করে করে প্যারিস শহরের অনেকখানি দেখা হয়ে গেল। গীর্জা বাহির থেকে দেখেও আমরা মুগ্ধ! পুরো প্যারিস শহরটাই যাদুঘরের মতো। প্রতিটি বিল্ডিং-এই এতো সুক্ষ্ম কারুকাজ যে মনে বিস্ময় জাগিয়ে তোলে, কিভাবে সম্ভব! কিন্তু গীর্জার বাইরে লম্বা লাইন থাকায় আমরা আর ভেতরে ঢুকলাম না। সেখান থেকে আবার আইফেল টাওয়ারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম, হাঁটতে হাঁটতেই। দূর থেকে টাওয়ারের মাথা দেখে দেখে সেই দিকে হাঁটতে লাগলাম। তখন প্রায় ভর দুপুর। সাথে কিছু শুকনো খাবার ছিলো, তাই খাওয়া হয়েছে। তারপরও কিছুটা ক্লান্ত। কিন্তু বেশ কয়েকবার চেষ্টার পরও বাসের সন্ধান পাওয়া গেলনা। তাই হন্টনই একমাত্র উপায় ছিলোপ্যারিসের সেইন নদীর ধার ধরে হাটতে লাগলাম। কিছুক্ষন পর মজার একটা বিষয় খেয়াল করলাম। নদীর ধারের রেলিং ধরে হাজার হাজার তালা ঝুলছে! প্যারিসে যারা বেড়াতে আসে তারা স্মৃতিচিহ্ন হিসাবে তালা ঝুলিয়ে রেখে যায়। সেখানে আবার বিভিন্ন রকম মেসেজ লিখা আছে। এভাবেই ন্যাশনাল এসেম্বলি সহ বিভিন্ন যাদুঘর বাইরে থেকে দেখতে দেখতে আইফেল টাওয়ারে পৌছে গেলাম।
ততক্ষনে প্রায় তিনটা বাজে। একটা বেঞ্চে বসলাম পা দুটোকে বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। এর মাঝেই রাহুল সাহেবের মনে পড়ল তার ব্যাগে ওয়াইন আছে। গতকাল কিনেছিলেন, শেষ করতে পারেন নি, অর্ধেক অবশিষ্ট আছে। বের করে এক চুমক খেয়ে আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন “আপনি খাবেন?” দেশে যদি কখনো এরকম পরিস্থিতি হতো, আমাকে কেউ মদ খাওয়ার অফার করত, আমি নিশ্চয়ই ফিট হয়ে পড়ে যেতাম। আমার ধর্মীয় মুল্যবোধ বেশ শক্তিশালী, তাই কৌতুহল কম। মনে হতো এর চেয়ে বদমাশ লোক আর পৃথিবিতে নেই! কিন্তু তখন সেরকম কিছু মনে হলনা। কারণ এর আগে আমাদের ট্রেনিং-এ ডিনারে ব্রেডের মতো ওয়াইনও রেগুলার আইটেম ছিলো। সাইকোলজিস্টের সংখ্যায় যেহেতু মেয়েরা বেশী, তাই মেয়েদের অনুরোধই বেশী প্রত্যাখ্যান করতে হয়েছে। তাই এখানেও সংক্ষেপে বললাম “না”। তখন তিনি বললেন “আরে নেন, না হলে আমি কিন্তু পুরোটা খেয়ে ফেলব”। আমি হেসে ফেললাম, বললাম “নির্দিধায়”।

ততক্ষনে উনার যাবার সময় হয়ে গেছে। আমাকে বারবার করে বললেন আমি যেন ভালো করে সময় নিয়ে আইফেল টাওয়ার দেখি। সন্ধ্যার পরে যে টাওয়ারটি দেখতে পুরাই অন্যরকম লাগে তাও বললেন, কোথায় বসে দেখব, কিভাবে হোস্টেলে ফিরব তাও দেখিয়ে দিলেন! তারপর বিদায়বেলা হাত বাড়িয়ে দিলেন হ্যান্ডশেক করার জন্য। আমি বললাম “আপনি কি খুব বেশী বিব্রতবোধ করবেন আমি যদি হ্যান্ডশেক না করি? আমার অভ্যাস নাই তো” তিনি বেশ সহজভাবেই বাড়ানো হাত টেনে নিলেন, বললেন “ না না ঠিক আছে, কমফোর্টেবল না হলে দরকার নেই”। তারপর চলে গেলেন।

যেখান থেকে আইফেল টাওয়ার সবচেয়ে ভালো দেখা যায় আমি সেখানে গিয়ে একটি বেঞ্চে বসলাম। পাশে ১৪ বা ১৫ বছরের গোলাপী একটি মেয়ে বসে আছে। তার হাতে একটি কাগজ যেখানে চার কোনায় চারটি লাভ চিহ্ন আঁকা। মেয়েটি গোলাপী রঙের নেইলপলিশ দিয়ে রঙ করছিল। তারপর মোবাইল দিয়ে তার ছবি তুলছিল। আমি আইফেল টাওয়ার দেখা বাদ দিয়ে তার কর্মকান্ড দেখতে লাগলাম। সে একই প্রক্রিয়ার আবার পুনরাবৃত্তি ঘটাল। ছবিটা ভালো করে তোলার চেষ্টা করছিল। আমার কৌতুহলী চোখ দেখে আমার দিকে তাকিয়ে হাসল। আমি হাসি ফিরিয়ে দিলাম। তারপর টুকটাক কথা বলা শুরু হলো। মেয়েটি ইয়েস নো ছাড়া আর কোন ইংলিশ জানেনা আর আমি ফ্রেঞ্চ সেটুকুও জানিনা। তারপরও দুজনের ভেতর ভাব হয়ে গেল। কিছুক্ষণ পর আমরা দুজন মিলে বেড়াতে গেলাম। আইফেল টাওয়ার, তার সামনের মেলা, নদীর ধারের বেড়নোর অংশটুকু ঘুরে বেড়ালাম। মেয়েটির সাথে প্রায় তিন ঘন্টা ছিলাম। এর মাঝে সেও অনেক কিছু বলেছে আমি বুঝতে পারিনি, আবার আমিও চেষ্টা করেছিলাম মনে হয়নি সে বুঝেছে। ইশারা ইঙ্গিতটুকুই ছিল ভরসা। তারপর সন্ধ্যায় আইফেল টাওয়ারের বাতিগুলো জ্বলে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে হোস্টেলে ফেরার উদ্যোগ নিলাম। সেই মেয়েটি আমাকে পথ দেখিয়ে মেট্রোতে নিয়ে গেল। এখান থেকেই তার পথ আর আমার পথ ভিন্ন। এতো মিষ্টি একটা মেয়ে, বিদায় নেয়ার সময় কিছুক্ষণ জড়িয়ে ধরে রইলাম, আর দেখা হবেনা।  যে নম্বরের ট্রেনে উঠার কথা তাতে উঠে পড়লাম, তারপরও আবার নিশ্চিত হবার জন্য একজনকে জিজ্ঞেস করলাম। তিনি বললেন যে এই ট্রেনই যাবে কিন্তু আমাকে বিপরীত রুট থেকে উঠতে হবে। তারমানে তখন আমি গন্তব্যস্থল থেকে আরো দূরে সরে যাচ্ছি! তাড়াতাড়ি পরের স্টপেজেই নেমে পড়লাম। মেট্রোর গোলকধাঁধায় পথ হারানো অস্বাভাবিক
নয়। অপরদিক থেকে আবার ট্রেনে উঠে গন্তব্যস্থলে পৌছালাম। তারপর সেখান থেকে প্যারিস শহরের প্রায় অর্ধেক মানুষকে জিজ্ঞেস করতে করতে হোস্টেলে পৌছালাম!

আমি এরপরের দিনও প্যারিসেই কাটিয়েছি। সেদিন সারাদিন একাই ঘুরে বেড়িয়েছি। সেদিনও অনেক নতুন অভিজ্ঞতা ছিল কিন্তু অলসতার কারণে আর লিখতে ইচ্ছে করছেনা। লেখাটা শুরু করেছিলাম নিজেকে নতুনভাবে আবিষ্কারের কথা দিয়ে। আমাকে দিয়ে যে কিছু হবে না তা আমি আগের মতো আর বিশ্বাস করিনা। আমার রিসার্চের কাজ নিয়ে কিছুটা স্টাক হয়ে আছি, ঘুরেফিরেই মাথায় চলে আসে আমাকে দিয়ে হবেনা। কিন্তু এখন আগের থেকে অনেক বেশী বিশ্বাস করতে পারি যে আমি পারব!

এখান থেকে আমার বন্ধুদের শুধু এটুকুই বলতে চাই যারা পারবনা মনে করে কোন লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যান, তারা ফিরে আসার পথ ভুলে গিয়ে কাজটিতেই ঝাঁপিয়ে পড়ুন। দেখবেন নিজের সম্পর্কে এমন অনেক নতুন ধারণা পাবেন যা আপনি নিজেই জানতেন না।

শনিবার, ১১ জানুয়ারী, ২০১৪

প্যারিস ঘুরে এলাম-১



শিরোনাম দেখে হয়তো অনেকেই ভাববেন এই লেখা এখানে কেন, ভ্রমণ বিষয়ক লেখা মানসিক স্বাস্থ্য সংক্রান্ত পাতায়! কিন্তু প্যারিস কত চমৎকার তা এই লেখার মূল বিষয়বস্তু নয়, প্যারিস ভ্রমণের সময় নিজেকে যে নতুনভাবে আবিষ্কার করলাম তা এই লেখার মূল উপজীব্য। সেই বিবেচনায় লেখাটা এখানে জায়গা পেতেই পারে।

যেহেতু বলেছি নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার অভিজ্ঞতা তুলে ধরবো, তাই পুরানো আমি সম্পর্কেও কিছু বলা দরকার। আমরা প্রত্যেকেই পরিবার ও পরিবেশ থেকে নিজেদের সম্পর্কে ধারণা লাভ করি। আমিও নিজের সম্পর্কে তেমন কিছু ধারণা নিয়েই বড় হয়েছি, যেমন অলস, অগোছালো, অপদার্থ ইত্যাদি। আমাকে দিয়ে যে কিছু হবেনা এই কথা আমি এতো শুনেছি যে বেশ সিরিয়াসলি বিশ্বাস করি। ছোটবেলা থেকে যে বিষয়টা ভালো পারতাম তা হলো বই পড়া। এখানেও কিন্তু আছে, পড়ার বই না গল্পের বই। কিন্তু আমি যেহেতু এতো অলস প্রকৃতির পড়াশোনা করলেও যে আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা এ বিষয়ে সবাই একমত ছিলো। একথা সত্যি ঘরের কাজের ক্ষেত্রে আমি অনেকটাই অলস। এখনো রান্না করার চেয়ে না খেয়ে থাকাটা সহজ মনে হয়! তবে আমার এই অলস হয়ে তৈরি হওয়ার পেছনে আমার পরিবারের ভূমিকা নেহাত কম নয়। আমার বাবা আমার কাজগুলো করে দিতে খুব পছন্দ করে, আমার পড়াশোনাটাও আব্বু করে দিত, শুধু সম্ভব নয় বলে আমি করতে শিখেছি। যার ফলে বইয়ের জগতের বাইরে কোন কিছু সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা জন্মায়নি। আমি স্বভাবে অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ এবং নড়বড়ে আত্মবিশ্বাস নিয়ে বড় হয়েছি।

মাস্টার্সে ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিতে ঢোকার পর নিজেকে রিফর্ম করার উদ্যোগ নিলাম। আমার সুপারভাইজর বললেন ক্লায়েন্টকে যে হোমওয়ার্ক দিব তা যেন নিজে আগে অনুশীলন করে নেই। নিজেকে বোঝা ও পরিবর্তনের ক্রমাগত প্রচেষ্টাই আমাকে পেশাগত দিকে সফলতা লাভের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে দিলো। যার ফলশ্রুতিতে পরিবারের প্রতি অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা কাটিয়ে উঠার জন্য দেশের প্রায় শেষ প্রান্তে একটি আন্তর্জাতিক বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে চাকুরিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। উপরোক্ত সমালোচনার পাশাপাশি পরিবারের সমর্থনের কথা উল্লেখ না করলে অন্যায় হবে। চাকুরিতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে আমাকে যুদ্ধ করতে হয়নি। আমাদের পরিবারের মানুষগুলো যখন আমাদের সমালোচনা করে তারমানে এইনা যে তারা আমাদের ভালোবাসে না, তারা শুধু বুঝতে পারেনা নেতিবাচক এই কথাগুলো মানুষের আত্মবিশ্বাসকে কতখানি গুড়িয়ে দেয়!

মেন্টাল হেলথ কোর্স ট্রেনিং-এর জন্য যখন আবেদন করেছিলাম, অনেকখানিই আত্মবিশ্বাস ছিলো যে সিলেক্টেড হবো। কিন্তু নিজেকে গুছিয়ে রাখতে পারব, কোন ভুলভাল ছাড়াই ঠিকমতো পৌছাতে পারব এই বিষয়ে অতটা আত্মবিশ্বাস ছিলনা। কারণ ট্রেনিং হবে নেদারল্যান্ডের এগমন্ডে। শুধু মনে হতে লাগল আমি নিশ্চয়ই পাসপোর্ট হারিয়ে ফেলব, বা জরুরী কিছু হারিয়ে ফেলব বা ফেলে যাব। যাওয়ার আগের রাতে ঘুমাতে পারলাম না।

আমস্টার্ডামের শিফল এয়ারপোর্ট থেকে হোস্টেল পৌঁছানোই প্রথম চ্যালেঞ্জ ছিলো। লাগেজ কালেক্ট করার সময় মনে হতে লাগল আমি বোধহয় আমার লাগেজ চিনতে পারবনা। এই চিন্তা আসা মাত্রই হার্টবিট বেড়ে গেল! প্রায় অনেক্ষণ পরেই লাগেজ উদ্ধার করতে পারলাম। প্লেনে আমার পিছনের সিটে থাকা এক বয়স্ক দম্পতি আমাকে ম্যাপ বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করলেন, টিকেট কাটতে সহায়তা করলেন এবং প্লাটফর্মও দেখিয়ে দিলেন যেখান থেকে ট্রেনে উঠতে হবে, মাঝে আবার ট্রেন চেঞ্জ করতে হবে তারপর আবার বাস। এতো বেশি স্ট্রেস কাজ করছিল যে ভাল করে কিছু চিন্তাও করতে পারছিলাম না। ট্রেন আসলো, আবার আরেক ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করলাম এটাই সেই ট্রেন কিনা কনফার্ম হওয়ার জন্য। ভদ্রলোককে এশিয়ান মনে হলো, কিন্তু তা জানার সুযোগ ছিলনা। লাগেজ টেনেহিচঁড়ে উঠলাম, তিনিও উঠলেন। আমি উঠেই কোন স্টেশনে আবার নামব তা বলার জন্য মুখ খুলতেই ট্রেন ছেড়ে দিলো, আর সাথে সাথেই আমি ম্যাট্রিক্স ছবির মতো পেছনে দিকে পড়ে যেতে লাগলাম। ভদ্রলোক আমাকে হাত বাড়িয়ে ধরে ফেললেন। ট্রেনে এতোগুলো মানুষের সামনে আমি পড়ে যাচ্ছি আর অপরিচিত এক ভদ্রলোক হাত ধরে আমার পতন রোধ করেলেন, যে কোন স্বাভাবিক সময়ে এই লজ্জাতেই আমি মরে যেতে চাইতাম। কিন্তু ওই মুহুর্তে আমি দ্বিতীয়বার ভাববার অবকাশ পেলাম না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়েই ম্যাপ দেখিয়ে জানতে চাইলাম “আমি এখানে নামব, কখন নামতে হবে আপনি কি একটু বলে দিতে পারবেন?”

আমি ঠিকমতোই হোস্টেলে পৌঁছেছিলাম, তবে সেখানে অনেক মানুষের অবদান আছে। সেই ডাচ ভদ্রমহিলার কথা না বললেই নয়, যিনি আমার লাগেজ নিয়ে প্রায় দৌড়ে আমাকে বাসে তুলে দিয়েছিলেন। কারণ সেখানে একঘন্টা পরপর বাস ছাড়ে, না হলে আমাকে একঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হতো। এগারোদিনের ট্রেনিং-এর পর যখন প্যারিসে বেড়াতে যাওয়ার সময় আসল সেই রাতেও ঘুমাতে পারিনি। এক অজানা ভয়ে মাথা গরম হয়ে যাচ্ছিল। কারণ এর পরে পুরোটাই একা। এই কদিন বিভিন্ন দেশের হলেও একই প্রতিষ্ঠানের সদস্যদের সাথে ছিলাম। অনেকের সাথেই ভালো বন্ধুত্ব হয়ে গেছে। যেকোন সমস্যাই, সমস্যা বলে মনে হয়নি। আমার ভেতরে কিছু শিশুসুলভ আচরণ আছে, যার কারণে যেখানেই থাকিনা কেন কেউ একজন গার্জিয়ানে ভূমিকা নিয়ে নেয়। ট্রেনিং-এও একজন ইন্ডিয়ান আপু ছিলেন! কিন্তু পরবর্তি পাঁচ দিন আমি নিজেই সম্বল। মনে হতে লাগল আমি সকালে নিশ্চয়ই বাস মিস করব, হয়তো কিছু ভুলে ফেলে যাব, ফ্রেঞ্চরা নাকি ডাচদের মতো বন্ধুসুলভ না, তারা ইংলিশ বলতে চায়না, কোন কিছু জানতে চাইলে উত্তর দেয়না, ভাবতে ভাবতে মাথা হ্যাং হয়ে যাচ্ছিল। কি হবে আমার, আর প্যারিসের পকেটমারদের এতো এতো সুনাম শুনেছি যে কিছু না হারিয়ে ঠিকঠাক মতো ফিরতে পারব তা অসম্ভব মনে হচ্ছিল।
সকালবেলা ঠিকমতোই বাস কাউন্টারে এসে পৌছালাম। আমার দুইহাতে দুইটি শপিংব্যাগ, যার একটি যে কোন মুহুর্তে ছিড়ে জিনিসপত্র সব ছড়িয়ে পড়তে পারে। শপিংব্যাগের রহস্য হলো মূল লাগেজ অফিসে রেখে এসেছি, পরামর্শ ছিলো এতো বড় লাগেজ যেন প্যারিসে না নিয়ে যাই, শুধু যা লাগবে সেটুকুই নেই। দেখা গেল শুধু স্যুটকেসটাই অফিসে পাঠিয়ে দিয়েছি, জিনিসপত্র বেশিরভাগই বাইরে। যার ফলশ্রুতিতে দুই হাতে দুই পলিথিনের ব্যাগ, যার একটা ছিড়ে যায় যায় অবস্থা! খুব স্বতস্ফূর্ত ভাবেই মাথায় চলে এলো যে আমাকে দিয়ে কিছু হবেনা। কিন্তু সেই পরিস্থিতিও সামলে নিতে পেরেছিলাম।
রাতের ঘুম বাসে ঘুমালাম। পাশের সিট ছিল খালি তাই কোন কিছু নিয়ে ভাবতে হল না। সাত ঘন্টা জার্নির পর প্যারিস গ্যালিনিতে এসে পৌছালাম। ভাবলাম এখান থেকেই হোস্টেলে সরাসরি চলে যাওয়া যাবে। কিন্তু একজন দেখিয়ে দিলেন আমি যেখানে আছি তা প্যারিসের শেষ প্রান্ত। শহরে যেতে আরো কিছু সময় লাগবে। মেট্রোতে দুইবার ট্রেন চেঞ্জ আর আরো একবার বাস আর কি! এখন মেট্রোতে কোথা থেকে উঠব বুঝতে পারছিনা, মানুষজনও নাই জানতে চাওয়ার মতো। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, তিনি সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে বললেন জানেন না। বেশী অবাক হইনি, ফ্রেঞ্চরা অমিশুক হয় সে বিষয়ে অনেকেই বলে দিয়েছিল। পরে এক ইন্ডিয়ান ভদ্রলোক ট্রেনের টিকিট কেটে কোন ট্রেনে উঠবো দেখিয়ে দিলেন। মেট্রোতে বসে যখন কানে বাংলা কথা ভেসে আসল ভাবলাম হ্যালুসিনেশন হচ্ছে কিনা! ঘাড় ঘুড়িয়ে দেখি একজন মোবাইলে বাংলায় কথা বলছে, বাংলাদেশী বাংলায়। দুই চারটা বাক্য বিনিময়ের পরের স্টপেজেই তিনি নেমে গেলেন। আমিও নেমে যখন পরের ট্রেনে উঠে যার কাছে জানতে চাইলাম ট্রেনটি মপারনেস যাচ্ছে কিনা, তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন “আপা আপনি কি বাংলাদেশী?”। ২০ বা ২২ বছরের একটি ছেলে। সে বলল “ আপা চিন্তা কইরেন না, আমিও ওইখানেই নামমু”। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কি করে, এখানে পড়াশুনা করে কিনা। সে বলল এখানে চাচাদের কাছে আসছে, কিছু করেনা, খায়দায় আর ঘুরে। প্যারিসে কেউ খাচ্ছেদাচ্ছে আর ঘুরছে জেনে ভালই লাগল। ট্রেন থেকে নেমে স্টেশন থেকে বের হওয়ার পথে ছেলেটি তার চাচতো ভাইয়ের কাছে নিয়ে গেলো। বললো “ এই আপা বাংলাদেশ থেকে আসছে, ৯৫ নাম্বার বাসে যাইবো। কোনখান থেকে উঠবো জানো?”। তার ভাই সেখানে ফুল বিক্রেতা। বাংলাদেশ থেকে এসেছি শুনেই এগিয়ে এসে হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিলেন। আমিও বেশী বাঁধা দিলাম না কারণ কাঁধ ব্যাথা করছিলো। বাংলাদেশ থেকে কবে এসেছি, কদিন থাকব, দুপুরে কিছু খেয়েছি কিনা, কোথায় থাকব এরকম প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে এগিয়ে চললাম। আমি একা এসেছি শুনে বললেন “কেমন হইল আপা, একা একা আসলেন, দুলাভাইরে নিয়া আসলে কত ভালো হইতো!” আমিও পুরোপুরি একমত। দুলাভাইকে নিয়ে আসতে পারলে অবশ্যই অনেক ভালো হতো, কিন্তু শুধুমাত্র প্যারিস ট্রিপের জন্য এতো শর্ট নোটিসে দুলাভাই জোগাড় করা যায়নি, কি আর করা! তারপর উনি আমাকে বাস কাউন্টারে রেখে, কিছু না খাওয়াতে পারার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বিদায় নিলেন। কিছুক্ষণ পর বাস আসার পর আমি উঠে এই ঠিকানায় যাব বলতেই ড্রাইভার গম্ভীর গলায় বললেন যে আমাকে রাস্তার ওপারের কাউন্টার থেকে উঠতে হবে। ফলে নেমে রাস্তা পার হয়ে আবার দাঁড়ালাম। কিছুক্ষন আবার বাস আসল, আমি ড্রাইভারকে বললাম আমি এই ঠিকানায় যাব, বাসটা সেখানেই যাবে কিনা। ড্রাইভার বলল “I don’t speak English, I don’t speak English”. বলে বাস ছেড়ে দিল। সে ইংলিশ বলেনা তা বুঝতে পারলেও বাসটা সেখানে যাবে কি যাবে না তা বুঝতে পারলাম না। এদিকে আবার বাস চলতে শুরু করেছে। আশেপাশের মুখগুলি দেখে সাহস পেলাম না। কেউ ইংলিশে কথা বলেনা। পরে আমার বয়সী একটি মেয়ে আমাকে বুঝিয়ে দেয়ার চেষ্টা করল, অতিকষ্টে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংলিশ পুনরুদ্ধার করতে পারলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম আমি যে যাচ্ছি আমার কি টিকেট লাগবেনা। পরে সে ড্রাইভারের সাথে কথা বলে টিকেট কেটে দিল। বাস ড্রাইভারের আচরণে একটু আহত হয়েছিলাম। ফ্রেঞ্চরা যে rude তা আবারো মনে পড়ল। তারপর নির্দিষ্ট স্টপেজে নেমে গেলাম। সাথে একজন বয়স্ক মহিলাও নামলেন। ড্রাইভারকে মনে হলো তাকে কিছু বলে দিলেন। আমি হোস্টেলে ঠিকানাটা দেখিয়ে কোথায় হতে পারে জানতে চাইলাম। ভদ্রমহিলা ইংলিশ বলেন না আর আমি একবর্ণও ফ্রেঞ্চ বুঝিনা। সৌভাগ্যক্রমে বিল্ডিং-এর নাম্বারগুলো ইংরেজিতেই ছিল। তিনি আমাকে দেখিয়ে দিতে লাগলেন। আমার সাথে সাথে এসে হোস্টেল পর্যন্ত খুঁজে বের দিলেন। উনাকে জড়িয়ে ধরে বিদায় দিলাম, তিনিও কিছু বললেন, বুঝতে পারিনি, কিন্তু ভালো কিছু যে সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। ভালোবাসার প্রকাশ সার্বজনীন, ভাষার প্রতিবন্ধকতা খুব বেশী প্রভাব ফেলতে পারেনা। তাই ফ্রেঞ্চরা যে অমিশুক হয় সেই ধারণাটা একটু পরিবর্তন করে নিলাম, হয়তো অধিকাংশ ফ্রেঞ্চরাই অমিশুক হয়, কিন্তু সবাই নয়।

হোস্টেলের রিসিপশনে ফ্রেঞ্চ মুভি থেকে উঠে আসা নায়কের মতো রিসিপশনিস্ট ছিলো। তার কাছ থেকে কার্ড ও অন্যান্য কিছু বুঝে নিয়ে নিজের রুমে চলে গেলাম। চার বেডের ফিমেল ডর্ম। রুমে তখন আর কেউ ছিল না। ব্যাগট্যাগ গুছিয়ে রেখে, বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে এসে বিছানায় আরাম করে বসার পর প্রথমবার মনে হলো, “My goodness!!! আমি এখন প্যারিসে, সত্যি সত্যি!!!