বৃহস্পতিবার, ১২ জানুয়ারী, ২০১৭

বর্তমান সামাজিক অস্থিরতা ও আমাদের ধর্মীয় মূল্যবোধ



এক অস্থির সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা যেখানে খুন, ধর্ষন প্রতিদিনকার চিত্র। সমাজে অপরাধ যে আগেও ছিলনা তা নয় কিন্তু বর্তমানে অপরাধের হার যেমন বেড়েছে তেমনি তার ধরনেও যোগ হয়েছে ভিন্নমাত্রা। আমরা যখনি কোন আতঙ্কময় ঘটনার বর্ণনা শুনছি, শিউরে যেমন উঠছি তেমনি আবার কিছুদিনের মধ্যেই নতুন কোন ঘটনার ভীড়ে আবার ভুলেও যাচ্ছি। তবে এ বিষয়ে সবাই একমত সমাজে অপরাধের ধরন বদলে গেছে। শিশুদের প্রতি ভয়াবহ নৃশংস অত্যাচার, সেগুলোকে ভিডিও করে আবার সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতে ছেড়ে দেয়া বা মায়ের হাতে সন্তানের মৃত্যুর যে ঘটনাগুলো সম্প্রতি ঘটছে তা এক দশক আগে কেন বছর পাঁচেক আগেও মনে হয় এভাবে দেখা যায়নি। মানুষ যে আর মানুষ নেই, সমাজে কোথাও যে আর নিরাপত্তা নাই এই বিষয়ে বিভিন্ন আলাপ আলোচনায়, চায়ের দোকানের আড্ডায়, স্কুলের সামনের মায়েদের জমায়েতে সবাই একমত পোষণ করছেন। ভবিষ্যৎ-এ আরো কি কি দেখতে হবে সেই শঙ্কা প্রকাশ করছেন, তারপর আবার জীবনের তাগিদে আবার সেই চলমান অসুস্থ প্রতিযোগিতার পিছনেই সবাই ছুটছেন।
বর্তমানে মিডিয়ার কল্যাণে যে কোন ঘটনাই আমরা সহজেই জেনে যাই। অনেক অনেক ঘটনার ভেতরে যে ঘটনাগুলো আমাদের হজম ক্ষমতার বাইরে চলে যায় সেগুলোর সমালোচনার মুখর হয়ে উঠি। সেগুলার সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বনশ্রীতে মায়ের হাতে দুই ফুটফুটে শিশুর মৃত্যুর খবর এখন আমরা ভুলেই গেছি। সেই খবরের পর এরকম আরো কয়েকটি একই ধরনের ঘটনা ঘটে গেছে। এরপর আমরা হয়তো এরকম খবরেও আর বিচলিত হবনা। তনু হত্যার বিচার চাওয়ার রেশ এখনো কিছুটা আছে কিন্তু এরই মাঝে ঘটে গেছে নারী নির্যাতনের আরো বেশ কিছু ঘটনা। জমি নিয়ে বিরোধে মারামারি, কোপাকুপিতে আমরা এখন আর নজর দেই না। ব্লগারসহ বিভিন্ন টার্গেট কিলিং –ও ঘটছে নিয়মিত ব্যবধানে।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ঘটনা যেমন ঘটছে, তেমনি চলছে ধর্মীয় চরমপন্থিদের আগ্রাসন, তেমনি ঘটছে সামাজিক অবক্ষয়ের অপরাধসমূহ। মিডিয়ার কল্যাণে শুধু আমরা অপরাধ সম্পর্কেই জানতে পারছিনা, অপরাধের কারণসমূহও জানতে পারছি। ঘটনা ঘটে যাওয়ার পর অনেক সমাজবিজ্ঞানী, মনোবিজ্ঞানী, অপরাধ বিশেষজ্ঞ তাদের মতামত প্রকাশ করছেন। কিন্তু আমার প্রশ্ন হলো আমরা আসলে প্রতিরোধমূলক কি পদক্ষেপ গ্রহণ করছি?  এখনই কি সর্বোচ্চ সময় নয় প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ গহণ করার? আর সেজন্য আমরা শুধু কি রাষ্ট্রের দিকেই তাকিয়ে থাকব? পারিবারিক, সামাজিক ভাবে আমাদের কি কোন দায়িত্ব নেই?
এখন আমরা আমাদের পাশের ফ্লাটে কোন জঙ্গি সংগঠন বোমা বানালেও বলতে পারি না কারণ সামাজিকভাবে আমরা বিচ্ছিন্ন। আমাদের সময় কাটে হিন্দি সিরিয়ালে আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর ভার্চুয়াল সাইটে, যা কিনা আমাদের সমাজে পরকীয়া, অবাধ যৌনতা আর পারিবারিক সম্পর্কের ভাঙ্গন ধরিয়ে দিচ্ছে। হিন্দী সিরিয়ালেও হয়তো ভালো কিছু ছিলো কিন্তু তা আমরা কোথায় শিখছি? যে কেউ হিন্দী সিরিয়ালগুলো খেয়াল করলেই দেখতে পাবেন তারা তাদের ধর্মীয় রীতি-নীতিগুলোকে খুব নিঃসংকোচে তুলে ধরছে। হিন্দুদের বিভিন্ন পূজা পার্বণ, আনুষ্ঠানিকতা দিয়েই প্রতিটি সিরিয়ালের প্রতি পর্বের পাঁচ থেকে দশ মিনিট সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। যা দেখে দেখে এখন আমাদের সমাজের অনেক মুসলিম মেয়েরাও মঙ্গলসূত্রের অনুকরণে গহনা বানিয়ে থাকেন, সিঁথিতে সিঁদুর পরতে উৎসাহী বোধ করেন বা স্বামীর দীর্ঘায়ুর জন্য কারওয়া চৌথের মত কিছু একটা করতে চান। এসবকিছুই ভিনদেশী সংস্কৃতির প্রভাব যেখানে স্বামীদের মনে হয় অন্যের স্ত্রী সঙ্গে প্রেম থাকাটা এখন সামাজিক মর্যাদার অংশ!  
ভারতের মিডিয়াতে ধর্মীয় আচারের এত প্রাধান্য দেখে মনে হয় তারা তাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে গর্বিত যেখানে আমার মনে হয় আমরা আমাদের সমাজে আমাদের ধর্মীয় পরিচয় বা মূল্যবোধ নিয়ে অনেকেই খুব লজ্জার ভিতরে থাকি। আন্তর্জাতিক ভাবে মুসলিমদের নিয়ে নেতিবাচক প্রচারণাও এর কারণ হতে পারে বা আমাদের দেশী মিডিয়াতেও ইতিবাচক প্রচারণা খুবই কম হওয়াটাও একটা বড় কারণ হতে পারে। আমাদের নাটকে বা সিনেমাতে দাড়ি টুপিওয়ালা লোক থাকলেই বুঝতে হবে সে আসলে খারাপ মানুষ, ভং ধরে থাকে। হয় সে নারী নির্যাতনকারী নয় সে পাকিস্তানের সমর্থক। ধর্মীয় চরিত্রের দ্বিমূখী, নেতিবাচক রূপ আমাদের ধর্মীয় মতামত প্রকাশে নিরুৎসাহিত করে তোলে। আমাদের কাছে বুদ্ধিজীবী, প্রগতিশীল মানুষ মাত্রই হলো যাদের ধর্মীয় বিশ্বাস নেই, অন্তত ইসলাম ধর্মে নেইকিন্তু এই ধারণা কতখানি সত্য? কে বলেছে নিজেকে বুদ্ধিজীবী হিসাবে জাহির করতে গেলেই নিজের ধর্মীয় পরিচয় বিসর্জন দিতে হবে বা ইসলাম ধর্মকে নিয়ে সমালোচনাপূর্ণ লেখা লিখতে হবে? ইসলাম বিরোধী লেখা লিখতে পারলেই সে সংস্কৃতমনা, প্রগতিশীল আর বুদ্ধিজীবী কাতারে আর সমর্থনে লিখলেই কূপমুন্ডুক? ধর্মান্ধতা আর ধর্মীয় মূল্যবোধের চর্চা যেমন এক হতে পারে না তেমনি ধর্ম বিরোধী কথা বলা বা লিখা প্রগতিশীলতার পরিচয় হতে পারে না।
আমরা তখনি আমাদের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে আত্মবিশ্বাসী হবো যখন আমরা আমাদের ধর্মকে ভালোভাবে জানব। ধর্মান্ধতা আর জীবনযাপনে ধর্মীয় মূল্যবোধ চর্চার পার্থক্য করতে শিখব। বিদেশী সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ না করে নিজস্ব সংস্কৃতি ও ধর্মকে ভালবাসতে জানলে ও দৈনন্দিন জীবনে তা প্রয়োগ করলেই আমরা সামাজিক অবক্ষয়ের ও ধর্মীয় চরম্পন্থার অনেক অপরাধ সম্মিলিতভাবে মোকাবেলা করতে পারব।
ধর্মীয় মূল্যবোধের সঠিক চর্চা আমাদেরকে আরো সহনশীল করে তুলবে যা কি না সমাজে অপরাধ হ্রাস করতে করতে সহায়তা করবে। অপর্যাপ্ত ধর্মীয় জ্ঞানই অলপ বিদ্যা ভয়ংকরীর মতো হয় আমাদের ধর্মের নামে অপরাধী হতে সাহায্য করছে নয় ধর্ম বিমুখ করে তুলছে।