মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০১৪

ডিজিটালাইজেশনের মনোসামাজিক প্রভাব



সারা বিশ্বজুড়েই নিত্যনতুন ইলেকট্রনিক্স পণ্যের কদর রয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রা সহজ করার লক্ষ্যে , যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ থেকে সহজতর করার উদ্দ্যেশ্যে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের উদ্ভাবন প্রতিনিয়তই হচ্ছে। একটি মডেল বাজারে আসার পরপরই আবার তার নতুন মডেল বাজারে চলে আসছে। আমরা সবাই সেই নতুন মডেলের পণ্য ক্রয় করে নিজেকে আধুনিক বা আপডেট করে রাখছি।
প্রযুক্তির এই ব্যবহার শুধু ব্যক্তিগত পর্যায়েই নয়, রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকেও উৎসাহিত করা হচ্ছে। আমাদের বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে যুগোপযোগী পদক্ষেপ। প্রতিটি স্কুলে ছাত্রদের জন্য ইন্টারনেট সুবিধা হাতের নাগালে নিয়ে আসা হচ্ছে, মোবাইলের সিম ফ্রি দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও নানান পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে আমাদের জীবনমান উন্নয়নের জন্যকিন্তু আমাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বা আমাদের সমাজে তার কিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কি আমরা খেয়াল করছি??
আমাদের ওয়াই জেনারেশন এখন ডিজিটাল জীবন যাপন করে। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের দ্বারা তাদের নেটওয়ার্ক এখন অনেক বিস্তৃতকিন্তু এখানেও সেই কিন্তু রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো আমাদের সোশ্যালাইজেশনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে না কি আমাদের সামাজিকভাবে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছে আমরা আমাদের বেশীরভাগ সময় এখন ভার্চুয়াল জগতেই কাটাই, বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে। একটি গবেষনায় দেখা গেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের উদ্বেগে আক্রান্ত করে। সদ্য আপলোড করা ছবিতে কয়টা লাইক পড়ল, কে কি মন্তব্য করল এইসব বিষয়ে ব্যবহারকারীরা উদ্বেগে ভোগেন। মানসিক রোগ সনাক্তকরণে যে মানদন্ডগুলো ব্যবহার করা হয় ডি এস এম (diagnostic and statistical manual)  তার মধ্যে অন্যতমডি এস এম-এর পঞ্চম সংস্করণে ইন্টারনেট এডিকশন, ঘন ঘন সেলফি তোলা ইতিমধ্যেই মানসিক সমস্যা হিসাবে অন্তর্ভূক্ত হয়েছে।
মানসিক রোগ বা সমস্যা তৈরী করা ছাড়াও আমাদের সমাজে সামগ্রিকভাবে কিরকম প্রভাব পড়ছে তা যদি আমরা খেয়াল করি। আমরা এখন প্রতিনিয়তই প্রতিযোগীতার ভেতর পড়ে যাচ্ছি, অসুস্থ প্রতিযোগীতা। আমাদের এখন স্কুল বয়সী বাচ্চাদের মোবাইল, ল্যাপটপ দরকার হয়। না হলে তারা অন্যদের চেয়ে পিছিয়ে পড়বে, সেই ভয়ে বাবা মাও কিনে দেন। কথা হচ্ছে এখানেই শেষ হলে কথা ছিল। এই মোবাইল, ল্যাপটপগুলোর আজকে এক মডেল বের হলে কালকে তা পুরানো হয়ে যায়। নতুন মডেলে নতুন নতুন ফিচার যোগ হয়। ফলে পুরানোগুলোর আর আকর্ষণ থাকে না। তাই আবার নতুন মডেল কেনার তাড়না কাজ করে। যাদের টাকা পয়সা আছে কিন্তু সময় নাই তারা সন্তানদের জিনিসপত্র দিয়ে ঠান্ডা রাখেন, যাদের টাকা পয়সা নাই তারা সন্তানদের আবদারে বিব্রত বোধ করেন। পরিবারে শুরু হয় দ্বন্দ্ব। বাবা মা হন ব্যাকডেটেড যারা নতুন জেনারেশনের চাহিদা বোঝেন না। পরিবারগুলো এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো। প্রত্যেকেই নিজেদের মতো ব্যস্ত, মোবাইল বা ফেসবুক নিয়ে। কারো কারো অস্থিরতা এতো চোখে পড়ার মতো যে তারা এক মুহূর্ত মোবাইল ছাড়া থাকতে পারেন না। কিছু না হলে অকারণেই মোবাইল টিপাটিপি করতে থাকেন। একজন তরুণের সাথে কথা হয়েছিল যার ফেসবুকে বন্ধুর সংখ্যা ১৬০০ কিন্তু তার কমপ্লেইন ছিলো একা একা লাগে, তাকে কেউ ভালোবাসে না। পত্রিকায় পড়েছিলাম আইফোন-৬ কেনার জন্য একজন তার গার্লফ্রেন্ডকে বিক্রি করে  দিয়েছেন। অফিসে ফেসবুক ব্যবহারের জন্য অনেকেই চাকুরী হারাচ্ছেন, ভাঙছে বৈবাহিক সম্পর্কও। পর্ণোগ্রাফীর মাত্রা বেড়েছে আতঙ্কজনকভাবে, আজকে এর ভিডিও প্রকাশ পাচ্ছে তো কালকে তার ভিডিওস্কুলের ছোট ছোট মেয়েদেরও রেহাই নেই!!!
এই উদাহরণগুলো পড়ে হয়তো অনেকেই বলবেন এখানে শুধু প্রযুক্তির নেতিবাচক দিকগুলোকেই তুলে ধরা হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যাবহারের অসংখ্য ইতিবাচক দিক আছে যা হয়তো বলে শেষ করা যাবে না। তা নিয়ে দ্বিমত পোষণ করার কোন সুযোগই নেই। কিন্তু যে নেতিবাচক বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে তাও ফেলে দেবার মতো নয়। প্রযুক্তির পরিমিত ব্যবহার নেতিবাচক দিকগুলোকে অনেকাংশেই কমিয়ে আনতে পারে। শুধু তাই নয় আমরা প্রতিদিনই যদি নিজেকে কিছুটা সময় দেই, খেয়াল করার জন্য যে আজকের দিনটা কিভাবে ব্যায় করলাম তাহলে হয়তো লক্ষ্য রাখা সম্ভব হবে প্রযুক্তি ব্যবহারে আসক্ত হয়ে পড়ছি কিনা। যা ভালো লাগে শুধু তাই করার দিকে না ঝুঁকে যেটুকু প্রয়োজন সেই সীমা নির্ধারণ করে তা মেনে চলাটাই কঠিন। সারাক্ষণ মোবাইল টিপাটিপি না করে, ইন্টারনেটের জগতে দিনের অধিকাংশ সময় ব্যয় না করে যদি পরিবারের সদস্য, প্রতিবেশী, বন্ধুবান্ধবদের সাথে সময় কাটাই তা আমাদের মনের জগতকে বেশী স্থিতিশীল করে। কোথাও বেড়াতে বা খেতে যাওয়ার উদ্দেশ্য যেন ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়া না হয়। যখন যেখানে সময় কাটাই তা যেন উপভোগ করতে পারি। মোবাইলে ব্যালেন্স বা মেগাবাইট শেষ হয়ে গেলে তা যেন আমাদের উদ্বেগে আক্রান্ত না করে। সবাই যে গতিতে ছুটছে সেই গতিতে ছোটার তাড়না যেন আমাদের সারাক্ষণ অসুখী করে না রাখে।
প্রযুক্তির ব্যবহার কমিয়ে আনা আমার এই লেখার উদ্দেশ্য ছিল না। আমরা এমন একটা সময় দিয়ে যাচ্ছি এইরকম উদ্দেশ্য থাকলে তা শুধু উইশফুল থিঙ্কিং হিসাবেই রয়ে যাবে। কিন্তু প্রযুক্তির অপব্যবহার আমরা কমিয়ে আনতে পারি। নিজেরা সচেতন হলে, নিজেদের পরিবারে, সমাজে একটু সচেতন ভূমিকা রাখলে সবাই মিলে হয়তো  এই অপব্যবহার প্রতিরোধ করা সম্ভব।