শনিবার, ৮ জুন, ২০১৩

সাভার ট্রাজেডি এবং কিছু অভিজ্ঞতা!

উখিয়াতে যাওয়ার পর টিভি দেখা ও পেপার পড়া প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। মনে হতো দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। কিন্তু তারপরেও ঘটনার রাতেই খবর পেলাম সাভারে বিল্ডিং ধসের কথা। পাশের ঘর থেকে সেন্সেশনাল এই নিউজ দেখার জন্য ডাকাডাকি শুরু হলো। আমি কয়েকটা দৃশ্য দেখে নিজের রুমে ফিরে এলাম। এবং মাথা থেকে বের করে দেয়ার চেষ্টা করলাম। এটা খুবই স্বাভাবিক মাঝেমধ্যেই সাভারেসের  দু একটা বিল্ডিং ধসের ঘটনা ঘটবে, মানুষ মারা যাবে, অনেক আলোচনা হবে, পত্রিকায় লেখালেখি হবে, তারপর আবারো আরেকটি ঘটনা ঘটবে! ব্যাক্তিগতভাবে এতো আবেগপ্রবণ হওয়ার কিছু নাই। যুক্তি মস্তিস্ক বুঝলেও মন বোঝেনা। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হওয়া শুরু হলো। আমার সমস্যা এইটাই, করার কিছুই থাকে না কিন্তু নিঃশ্বাস নেওয়ার কষ্ট সহ বিভিন্ন লক্ষণ শুরু হয়। কিন্তু এইবার ঘটনার পরদিন ছুটির দিনে অফিস থেকে ফোন পেলাম যে সাভারের দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। আমার জন্য কি এই ছুটির সময়ে যাওয়া সম্ভব কিনা। কি বলে? আমি প্রতিটি মুহূর্তে কত কত বার ভাবছি, ইশ যদি আমি ঢাকায় থাকতাম! হয়তো ডিপার্টমেন্টের পক্ষ থেকে অংশগ্রহণ করতে পারতাম! পরদিনই অফিসের পক্ষ থেকে ঢাকায় চলে আসলাম সাভার ভিক্টিমদের প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য। লোকবল বাড়ানোর জন্য প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্য সেবার (Psychological First Aid, PFA) প্রশিক্ষণ দিয়ে নিলাম। তারপর ১২ জনের একটি দল নিয়ে এনাম মেডিক্যাল কলেজে পৌছে গেলাম। কলেজটির পক্ষ থেকে সর্বাত্মক সহযোগীতা পেয়েছি। কিন্তু যে বিষয়টি কাজের অসুবিধা করেছে তা হলো হাসপাতালটিতে সকলের অবাধ আনাগোনা। কেউ কয়েকটা বিস্কুট, লুঙ্গি-শাড়ী নিয়ে, কেউ ডোনেশন নিয়ে, কেউ বা শুধু এলাকার বা নিজের অঞ্চলের লোকদের জন্য ডোনেশন নিয়ে! কেউ কেউ ভিজিট করার জন্য, আবার একটি স্কুল থেকে আসা বাচ্চাদেরও দেখা গেল!!! দেখা গেল আমাদের মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দেওয়ার জন্য লাইনে দাড়াতে হচ্ছে! আমার এক্সপাট বস পরিস্থিতি দেখে খুবই বিরক্ত। তাই দুইদিনে কাজ শেষ করেই ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু আমার অর্গানাইজেশনের যেহেতু দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা ছিল তাই আমি রয়ে গেলাম।

দুর্ঘটনা পরবর্তী সময়ে যাদের অফিসিয়াল ডকুমেন্ট পাওয়া গিয়েছিল সেই প্রতিটি নাম্বারে ফোন করে তাদের মানসিক অবস্থার খোঁজ খবর নেয়া হয়েছিলো যেন এই প্রাথমিক মিডিয়ার ধাক্কা কাটার পর তাদের যখন আসলেই তাদের সাহায্যের প্রয়োজন পড়বে তার একটা পরিকল্পনা করা যায়। আমি নিজেই উপযাচক হয়ে প্রায় একশোর মতো ফোন করেছি যেন দুর্ঘটনা পরবর্তী মান্নসিক সমস্যা কি ধরনের হতে পারে তা ভালো করে উপস্থাপন করতে পারি। তারপর পরিকল্পনাকালীন সময়ে আবার নিজ কাজের ক্ষেত্র উখিয়াতে ফিরে গেলাম।

সপ্তাহখানেক পরই আবার ঢাকায় দ্বিতীয় দফা কাজ শুরু করার জন্য। সাথে কানাডিয়ান মেন্টাল হেলথ অফিসার। তিনি শুধু যেন একক ভাবেই না গ্রুপেও ভিকটিমদের সাপোর্ট দিতে পারি সে বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিলেন। এর পাশাপাশি ঢাকা ইউনিভার্সিটির সাইকোলজির ও ক্লিনিক্যাল সাইকোলজির স্টুডেন্টদের ধন্যবাদ পাওনা যারা এই ধাপে আমাকে সহায়তা করেছে। তাদের অদম্য ইচ্ছাই পরীক্ষা মাথায় নিয়েও তারা এই মহৎ একটি কাজে সম্পৃক্ত হতে উদবুদ্ধ করেছে!

দ্বিতীয় আমার কাজ ছিলো মূলতঃ কাজটিকে শুরু করিয়ে দেয়া। প্রথম গ্রুপ করে আশানূরুপ ফলাফল পাওয়ার পর আবার আমার নিজ কাজের জায়গায় ফিরে যাওয়ার সময় হলো। কাজ চলছে, প্রয়োজন সাপেক্ষে চলতে থাকবে।

এই কাজ চলাকালীন সময়েও অনেক সময় মানসিক চাপের মধ্য দিয়ে গিয়েছি। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়েছে, বুক ভার হয়ে গিয়েছে কিন্তু ভালো লাগার বিষয় একটাই ছিলো যে আমি কিছু করতে পারছি। ভালো লাগার আরো একটা বিষয় ছিলো যে এত বড় একটা দুর্ঘটনা আমরা অনেক ভালো করেই ম্যানেজ করতে পেরেছি যদি আরো একটু গুছিয়ে, সমন্বয় করে করতে পারতাম। আর যেন এরকম না ঘটে সেই প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা যদি গ্রহণ করা হতো!!!

মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল, ২০১৩

ভালোবাসার তত্ত্বকথা


              

সম্প্রতি একটা বই পড়লাম ‘The Psychology of Love’. বইটিতে ভালোবাসার থিওরী ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে একটা থিওরী বেশ আকর্ষণীয় লাগলো। বন্ধুদের সাথে শেয়ার করার জন্যই লেখার উদ্যোগ নিলাম। স্টার্ণবার্গ তার ভালোবাসার ত্রিভুজ তত্ত্বে ভালোবাসার তিনটি উপাদানের কথা বলেছেন। ঘনিষ্ঠতা, প্যাশন এবং সিদ্ধান্ত/কমিটমেন্ট- এর সমন্বয়েই নাকি তৈরী হয় ভালোবাসা। তবে প্রতিটি উপাদানেরই নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে। যেমন ঘনিষ্ঠতা উপাদানের ভিতরে আবেগ, অনুভুতি, উষ্ণতা, ভালোবাসার বন্ধন এই বিষয়গুলো রয়েছে। প্যাশন ব্যাক্তিকে আবেগ তাড়িত করে যা কিনা রোমান্টিক অনুভূতি, শারীরিক আকর্ষন, যৌন সম্পর্ক এই বিষয় গুলোকে ধারণ করে। সিদ্ধান্ত বা কমিটমেন্ট একজন ব্যাক্তিকে ভালোবাসা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে এবং ভালোবাসা ধরে রাখার মতো দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা করতে সহায়তা করে। এই তিনটি উপাদানের তারতম্যই একটা সম্পর্ক কতখানি স্ট্যাবল হবে, কতখানি নিয়ন্ত্রিত হবে বা কিভাবে মূল্যায়িত হবে তা নির্ধারণ করে। যেমনঃ কোন সম্পর্কে যদি ঘনিষ্ঠতা ও সিদ্ধান্ত/কমিটমেন্ট বেশী থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক স্থায়ী হবার সম্ভাবনা অনেক বেশী, আবার শুধু প্যাশন থেকে যে সম্পর্ক তৈরী হয় তা তুলনামূলক ভাবে কম স্থায়ী হতে দেখা যায়। স্টার্ণবার্গ তার এই তিনটি উপাদানকে হেরফের করে ভালোবাসার আটটি ধরনের কথা বলেছেন।

১। যে সব সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা, প্যাশন ও সিদ্ধান্ত/ কমিটমেন্ট কোন কিছুই থাকেনা সেগুলি ভালোবাসা বিহীন (non love) সম্পর্ক। যেমন আমরা দৈনন্দিন জীবনে অনেকের সাথেই প্রয়োজনীয় সম্পর্ক বজায় রাখি।
২। যে সব সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা বেশী কিন্তু প্যাশন বা কমিটমেন্ট কম সেই সম্পর্ক গুলো পছন্দের (liking) আওতায় পড়ে। যেমনঃ বন্ধুত্ব।
৩। প্যাশন যে সম্পর্কে বেশী থাকে কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ও কমিটমেন্ট থাকে না সেই সম্পর্ককে মোহ (infatuation) বলে প্রথম দেখায় প্রেমে পড়া যদিও অনেকের কাছেই আকর্ষনীয় কিন্তু স্টার্ণবার্গ একে মোহ বলে আখ্যায়িত করেছেন।
৪। যে সম্পর্কে শুধুমাত্র কমিটমেন্ট থাকে কিন্তু ঘনিষ্ঠতা ও প্যাশন কম থাকে তা হলো শূন্য ভালবাসা ( empty love) পারিবারিক ভাবে আয়োজিত বিয়েতে প্রাথমিক অবস্থায় এটি লক্ষ্য করা যায়।
৫। ঘনিষ্ঠতা ও প্যাশন বেশী থাকে কিন্তু কমিটমেন্ট থাকেনা তা রোমান্টিক ভালোবাসার (romantic love) বৈশিষ্ট্য।
৬। ঘনিষ্ঠতা ও কমিটমেন্ট বেশী থাকে কিন্তু প্যাশন কম থাকে তা অনেকটা সঙ্গীর মতো ভালবাসা (companionate love)
৭। ঘনিষ্ঠতা কম থাকে কিন্তু প্যাশন ও কমিটমেন্ট বেশী থাকে তা অনেকটা বোকার মত ভালবাসা (fatuous love) এটা অনেকটা ঝড়ের মতো ভালবাসা। ঘনিষ্ঠতা কম থাকায় সম্পর্কের স্থায়ীত্ব থাকেনা।
৮। যে সম্পর্কে ঘনিষ্ঠতা, প্যাশন ও কমিটমেন্ট সবকিছুই বেশী থাকে তা হলো পরিপুর্ণ ভালবাসা (consummate love). রোমান্টিক ভালোবাসায় আসলে সবাই এইরকম একটা পরিপূর্ণতায় পৌছাতে চায়।

বেশীরভাগ সম্পর্ককেই হয়তো একটি নির্দিষ্ট ভাগে ভাগ করা যাবেনা। কারণ সম্পর্কের চড়াই উৎরাইয়ে ভালোবাসার উপাদানগুলোর তারতম্যে বিভিন্ন পর্যায় আসতেই পারে! যেমন অল্প বয়সে মোহ (infatuation) অনেক বেশী লক্ষ্য করা যা কিনা সেই চিরন্তন সত্যের মতোই মনে হয়। হুটহাট করে প্রেমে পড়া এবং ছ্যাকা খাওয়া টিন এজারদের ক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক একটা বিষয়। যদিও বলা হয় ভালবাসা হিসাব করে হয়না কিন্তু একটা সম্পর্ক কিভাবে পরিপূর্ণ হতে পারে তার ধারণা হয়তো এই লেখা থেকে পেতে পারি। কারোন শুধু চোখের ভালো লাগাই নয়, একে অপরকে জানা, সম্পর্কের ঘনিষ্ঠতাও একটা সম্পর্ককে দীর্ঘমেয়াদী করতে কত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে এই থিওরী তা বলে দিচ্ছে!               

সোমবার, ৮ এপ্রিল, ২০১৩

মানসিক রোগ বনাম জ্বিন ভূতের আছর



রিতা একমাস ধরে কথা বলেনা। সারাদিন বোবার মত তাকিয়ে থাকে। একেবারেই চুপ, তাও না হয় সহ্য করা যেত কিন্তু গত পনের দিন সে হাত পা কুকড়ে ঝাকানি শুরু করেছে। একবার শুরু হলে ৫ থেকে ১০ মিনিট চলতে থাকে। শ্বশুরবাড়ীর লোকজন এই অদ্ভূত কান্ড দেখে ভীষন ভয় পেয়েছে। মৃগী রোগ কিনা বোঝার জন্য হাত পা ঝাকানোর সময় জুতা শুকিয়ে দেখা হয়েছে। খারাপ কোন কিছু আছর করেছে কিনা মসজিদের ইমামের পড়াপানি খাইয়ে দেখেছে। এরপরও কাজ না হওয়ায় বাবার বাড়ী পাঠিয়ে দিয়েছে। রিতার বাবা মা থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়েও সুরাহা পায়নি। মেয়েকে যে জ্বিনেই ধরেছে সে ধারনা পাকাপোক্ত হয়েছে। নিজ গ্রামের, ভিন গ্রামের পীর-ফকির, কবিরাজ সবার কাছেই ছুটোছুটি করেছেন মেয়েকে নিয়ে। রিতার বয়স আঠারো চলছে। দুই বছর ধরে বিয়ে হয়েছে, তার অমতে। স্বামী বিদেশ থাকত, মাসখানেক ধরে দেশে এসেছে। জ্বিনে ধরা বউ নিয়ে তো আর সংসার চলেনা তাই নতুন করে পাত্রী দেখা হচ্ছে।
রিতার সাথে আমার পরিচয় জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইন্সটিটিউটে। অনেক পথ পাড়ী দিয়ে তার এই হাসপাতালে আসা। পানিপড়াসহ ওঝা ফকিরের লাঞ্জনাও সহ্য করতে হয়েছে। তখনও সে কথা বলেনা এবং হাত পাগুলোকে অদ্ভূতভাবে ঝাকায়। রিতা কনভারসন ডিসঅর্ডারে আক্রান্ত ছিলো যার প্রচলিত নাম হিস্টিরিয়া। এক ধরনের মানসিক রোগ। সাইকোথেরাপী যেখানে চমতকার কাজ করে। রিতা একসপ্তাহের মধ্যেই সাইকোলজিস্টের সাথে কথা বলে। সে ছোটবেলা থেকেই নানুর বাসায় মানুষ। বাবার আর্থিক অবস্থা অত খারাপ না, সুযোগ সুবিধা বেশী বলে নানুর বাসায়ই থাকা হত। ক্লাস টেনে ওঠার পর এই বিয়ের প্রস্তাবটি আসে। ছেলে বিদেশ থাকে, অনেক পয়সা কামাই করে, টাউনে নিজেদের বাড়ী আছে। পাত্রপক্ষের এত আগ্রহ দেখে রিতার মামারা রাজী হয়ে যায়। রিতার মতামত কেউ জানার প্রয়োজন মনে করেনা। বিয়ের পর রিতা বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করলো যতটা আগ্রহ দেখিয়ে তাকে বিয়ে করিয়ে আনা হয়েছে বিয়ের পর তার বিন্দুমাত্র লক্ষণ নেইছোটখাট বিষয়ে তাকে কথা শোনানো হয়। বিয়ের পরপরই স্বামী বিদেশ চলে যায়। রিতার শ্বাশুড়ী তার স্বামীর সমা, নানান ছুতায় তাকে অপমান করেন। কাজকর্মে অদক্ষতার জন্য পদেপদে ভুল ধরা হয়। রিতা কোন কথা বললে তা আবার ব্যাঙ্গ করে তাকে শোনানো হয়। স্বামী ফোন করে শুধু তার পরিবারের লোকজনদের সাথেই কথা বলেন। রিতার অনুভূতির কোন মূল্য দেয়া হয়না। পড়াশুনা চালিয়ে না যাতে পারার দুঃখ আর এত আগ্রহের বিয়ের এই ফলাফল, বিভিন্ন সময়ে অপমানিত হবার অভিজ্ঞতা রিতার ভিতরে ভিতরে তীব্র দ্বন্দ্ব তৈরি করেযার বহিঃপ্রকাশ শারীরিক এই লক্ষণের মাধ্যমে ঘটে, কথা বন্ধ হয়ে যায়। হিস্টিরিয়ার বা কনভার্সন ডিসঅর্ডারের মূল কারণটাই হলো মানসিক কোন দ্বন্দ্ব যা ব্যাক্তির মনে অসচেতনভাবে কাজ করে এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটে। সাইকোথেরাপী মূলতঃ এই মানসিক দ্বন্দ্বটাই আবিস্কার করে। মানসিক চাপ কমে গেলে শারীরিক লক্ষণগুলো কমে আসে। যেমন সাইকোথেরাপীর কয়েকটি সেশনের পর রিতার শারীরিক লক্ষণগুলো ধীরে ধীরে কমে আসে। রিতার কোন শারীরিক সমস্যা ছিলোনা, সমস্যাটা পুরোপুরি মানসিক কিন্তু রিতার মতো অনেকেই এরকম জ্বিন ভূতের আছর সংক্রান্ত ভুল ধারণার শিকার হয়। জ্বিন ভূতের আছর তাড়ানোর নামে চলে অপচিকিতসাতার অন্যতম কারণ হচ্ছে মানসিক রোগগুলোর বিচিত্র লক্ষণসমূহ। শুধুমাত্র কনভারশন ডিসঅর্ডারেই এত ধরনের লক্ষণ দেখা যায় আর সেগুলো এতই অদ্ভূত যে তা মানসিক রোগ হিসাবে সাধারণের বোঝা সত্যি দুরূহ। তাছাড়া আমাদের সমাজে মানসিক রোগ সম্পর্কে রয়েছে নেতিবাচক ধারনা। মানসিক রোগ মানেই মনে করাই পাগল। মানসিক রোগ সম্পর্কে রয়েছে নানা রকম কুসংস্কার। এই কুসংস্কার দূর করার জন্য চাই যথাযথ পদক্ষেপ। মানসিক রোগ সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধির একটি গুরুত্বপুর্ণ উপায় হতে পারে পাঠ্যবইতে কিছু প্রচলিত মানসিক রোগের ধারণার অন্তর্ভূক্তি। প্রাথমিক শিক্ষায় শারীরিক রোগগুলোর মতো মানসিক রোগগুলোকেও পরিচয় করিয়ে দিলে মানুষ অনেক ভ্রান্ত ধারণা থেকে মুক্তি পাবে।

বুধবার, ৩ এপ্রিল, ২০১৩

ভুল বোঝা নয় ভুল্ভাবে বোঝার কথা বলছি!!!

আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই নানান ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনাগুলোকে আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করি বা নিজেদের মতো করে বুঝে নেই। পরিস্থিতিগুলো হয়তো এমন হয় যে, আমাদের মনে হয় আমরা যা চিন্তা করছি তার বিকল্প কিছু হতেই পারেনা। আমি যা ভাবছি তাই ঠিক - আমাকে বোঝানোর দরকার নেই, এরকমই আমরা মনে করি। আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নয় এইরকম চিন্তার ধরনগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ' distorted cognition’ বা চিন্তনের বিচ্যুতি। জ্ঞানীয় বা চিন্তনের বিচ্যুতি সাধারণত আমাদের মনে নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করে এবং এগুলো স্বাভাবিক চিন্তারই অতিরিক্ত বা অযৌক্তিক বহিঃপ্রকাশ। যেমন, কেউ হয়তো পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করল, সে কারনে মনে করলো ‘আমি আসলে অপদার্থ, আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা’।  বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও এখানে ব্যক্তি প্রথমতঃ নিজেকে একটি মার্কা মেরে দিলো যে আসলে সে অপদার্থ এবং ফলাফল খারাপ করার বিষয়টি সে সবক্ষেত্রে প্রয়গ করল যে তার দ্বারা কিছুই হবেনা। এ ধরনের চিন্তাগুলোই মানুষের জীবনের স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। যার ফলে মানুষ পদেপদে পিছিয়ে পড়ে। এ রকমই কিছু বিচ্যুত চিন্তা বা ভুলভাবে বোঝার ধরন মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলোঃ

১। হয় সব নাহলে না, হয় সাদা নয় কালোঃ এক্ষেত্রে ব্যক্তি যে কোন বিষয়বস্তু, ঘটনা অথবা অন্যদের সম্পর্কে মূল্যায়ন শুধুমাত্র দুইভাবে করে। যার ফলে প্রেক্ষাপটটির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। যেমনঃ অনেক শিক্ষার্থী মনে করে যদি তারা পরীক্ষায় প্রথম না হয় তাহলে তারা খারাপ ছাত্র, বা অন্যদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিটি ভালো না হয় তাহলে নিশ্চয়ই খারাপ।কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম না হলেই যেমন কেউ খারাপ ছাত্র হয়ে যায়না তেমনি কেউ ভালো নয় মানেই যে সে খারাপ তাও সঠিক নয়। এ ধরনের বিচুতিতে ব্যাক্তি চিন্তার ক্ষেত্রে চরমপন্থি হয়।

২। তিলকে তাল করা বা ভাগ্য অনুমান করাঃ এক্ষেত্রে যে কোন ঘটনাকে বড়ো করে দেখা হয় ঘটনা সম্পর্কে নেতিবাচক ভবিষ্যতবাণী করা হয়। যেমন কেউ হয়তো কাউকে মনের কথা জানিয়ে সাড়া পেলোনা তখন সে মনে করলো ‘আমাকে আসলে কেউ ভালোবাসেনা। আমি সারাজীবনই কষ্ট পাবো, এরকম অপমানিত হবো।

৩। নিজের ভালো দিককে গুরুত্ব না দেয়াঃ ব্যক্তি তার ভালো গুণ, দক্ষতা, কাজ বা অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করেনা। এ ধরনের কথাগুলোই তার উদাহরণ ‘ইংলিশে  পেয়েছি আমি ভালো ছাত্র বলে যে তা না, সেদিন প্রশ্ন সহজ হয়েছিল’ বা ‘ রান্না ভালো করি তো কি হয়েছে এটা তো সবাই পারে’ ইত্যাদি।

৪। আবেগীয় পক্ষপাতিত্বঃ ব্যক্তি আবেগীয়ভাবে এমন কোন ধারণার বশবর্তী হয় যা কিনা সত্যি নয় অথবা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। যেমন, অনেকেই অভিযোগ করেন যে ‘কোন কাজ করতে গেলেই মনে হয় আমি পারবনা। আমি আসলে কোন কাজের না’। অথচ কাজে নামিয়ে দিলে তারা তা ভালোভাবেই সম্পাদন করতে পারে।

৫।মার্কা লাগিয়ে নেয়া বা দেয়াঃ ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে বা অন্যদের সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মার্কা এঁটে দেয়। যেমন, অযোগ্য, অপদার্থ, অলস, কুঁড়ে, বাচাল, অমিশুক ইত্যাদি।

৬। উপসংহারে পৌছে যাওয়াঃ যে কোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে সেই বিষয়ের উপসংহারে পৌছানো। যেমন, ‘ আজকে যে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো তা আমার হাজবেন্ড ভুলেই গেছে। ও আসলে আমকে ভালোইবাসেনা’।

৭। নির্বাচিত বিষয়ই দেখাঃ ব্যক্তি শুধু সেই বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয় যা তার মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ কিন্তু সমগ্র ঘটনাটি বিবেচনা করে না। যেমন, অংকে পাওয়াটাই প্রমাণ করে যে আমার যোগ্যতা কতটুকু। অংকই তো আসল বিষয়। আর তাতেই ভালো করি নাই’।

৮। অন্যেরা কি মনে করবে তা বুঝে নেওয়াঃ এক্ষেত্রে অন্যেরা কি মনে করেছে বা কি মনে করবে ব্যক্তি নিজেই ঠিক করে নেয়। যেমন, আমি যদি তার কাছে ধার চাই তাহলে আমাকে নিশ্চয়ই আমাকে হ্যাংলা মনে করবে’। 

৯। অতিরিক্ত সাধারনীকরণঃ ব্যক্তি যে কোন একটি ঘটনাকে ধরে ফলাফলকে সবক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে। যেমন, ‘ দিবা সেদিন মার্কেটে আমাকে দেখেও কথা বলেনি, ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে। সবাই আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কেউ আমাকে পছন্দ করেনা।আমার কোথাও না যাওয়াই ভালো।টিচাররাও আমাকে পছন্দ করেনা। যেদিন পড়া পারিনা সেইদিনই ধরে’।

১০। নিজের উপর নেয়াঃ ব্যক্তি মনে করে সবাই শুধু তার সাথে খারাপ আচরণ করে বা যে কোন ঘটনার জন্যই নিজেকে দায়ী করে। যেমন, ‘বস যে মিটিংএ কথাগুলো বলছিলেন আসলে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছিলেন।কাজটাতো আমার জন্যই ভালো করে শেষ হয়নি।আমাকে বোঝানোর জন্যই বলেছেন’।

১১। করা উচিত ছিল বা করতেই হবে এমন বিবৃতিঃ যে কোন বিষয়েই অনেক বেশি রিজিড থাকে। আমার ভালো করা উচিত বা আমাকে ভালো করতেই হবে – মতামতগুলো এই ধরনের হয়। যার ফলে অনেক বেশী চাপের মধ্যে থাকে এবং প্রত্যাশা পূরণ না হলে ভেঙ্গে পড়ে।

১২। সংকীর্ণভাবে দেখাঃ যে কোন পরিস্থিতিতে ব্যক্তি শুধু খারাপ দিকগুলোই দেখে।যেমন, ‘আমার স্ত্রী কোন কাজই ঠিকমতো করতে পারেনা, না রান্না করতে পারে, না বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারে’। 

১৩। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোঃ ব্যক্তি তার যাবতীয় সমস্যার জন্য অন্যদেরকে দায়ী মনে করে এবং সে কারণে সেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ করে। যেমন, ‘তোমার কারণে আজকে আমার এই অবস্থা। সবকিছুর পেছনে তুমিই দায়ী’।

১৪। পরিবর্তনের দুরাশাঃ ব্যক্তি আশা করে অন্যেরা তার চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। তারা অন্যদের পরিবর্তন করতে চায় কারণ তাদের ভালো থাকার অনুভূতি অন্যদের উপর নির্ভরশীল।যেমন অনেক সময় আমরা আমাদের পছন্দের মানুষটিকে তার নিজস্বতাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মতো গড়েপিটে নিতে চাই। আর সেরকম না হলেই হয় মনোমালিন্য।

এই জাতীয় চিন্তনের বিচ্যুতিগুলো আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যহত করে, আমাদের সম্পর্কগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।এরকম ভুলভাবে বোঝার পরিমাণ যদি বেশী হয় তাহলে তা মানসিক সমস্যা তৈরী করে। যেমনঃ বিষন্নতা, সামাজিক উদ্বেগ বা ভীতি প্রভৃতি। সুতরাং আমরা যদি নিজেদের চিন্তাভাবনার গতিপথগুলোকে যাচাই করে সংশোধিত করে নিতে পারি তাহলে আমাদের জীবন আরো সহজ ও সাবলীল হয়ে উঠবে।   


শুক্রবার, ২৯ মার্চ, ২০১৩

বিশ্বাসে মিলায় বস্তু তর্কে বহুদূর!

কথাটি শোনেনি এমন কাউকে খুজে পাওয়া মুশকিল হবে! আবার শোনার পর খুব বেশী যে অবিশ্বাস করে তাও নয়! পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের বিশ্বাসে তারতম্য ঘটে বটে কিন্তু কথাখানি আমরা সহজেই সবাই মেনে নেই। তবে কিভাবে বিশ্বাসে লক্ষ্যবস্তু মিলায় সেই প্রক্রিয়াটি অনেকেরই অজানা। এই মনোবৈজ্ঞানিক প্রক্রিয়াটি আজকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব।
অনেক দিন আগে একটি নাটক দেখেছিলাম। একজন অসুস্থতার জন্য কাজের লোককে বিশেষ জায়গা থেকে পড়া পানি আনতে দিয়েছিলেন। কিন্তু ফাঁকিবাজ কাজের লোক কলের পানি বোতলে ভরে এনে দিয়েছে। রোগী সেই পানি খেয়েই সুস্থ!!! কিভাবে ঘটল এই যাদুকরী ঘটনা? ঘরের প্রবীণ একজন মন্তব্য করলেন “আল্লাহ্‌র উপর বিশ্বাস রাখলে সবই সম্ভব! আল্লাহ্‌ চাইলে খালি পানি খায়াই মানুষ ভালো হইতে পারে”। তা হয়তো হতে পারে। আজকে আমরা সেই বিষয়ে তর্কে যাবনা কিন্তু এর মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা জানব।
বাংলাদেশে যারা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা কাজ করেন তারা মূলত ‘Cognitive Behavior Therapy(CBT)’ ব্যবহার করেন। যার বাংলা হলো জ্ঞানীয় আচরণ চিকিৎসাপদ্ধতি। যেহেতু বাংলা এবং ইংরেজিতে কোনই তফাত নেই, দুটাই সমান কঠিন। এই চিকিৎসাপদ্ধতির মূল কথা হলো মানুষের আচরণগুলো তার চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটায়, যদি কারও আচরণগত সমস্যা দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে তার চিন্তন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি আছে। যদি আমরা চিন্তন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করতে পারি তাহলে আচরণও বদলে যাবে। তবে এখানে শুধু চিন্তা ও আচরণ এই দুটি উপাদানই নয় পরিস্থিতি, অনুভূতি ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া সহ আরও তিনটি উপাদান রয়েছে।
উপাদানগুলো আমি একটি চিত্রের মাধ্যমে দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। যেখানে সবগুলো উপাদান কিভাবে একে অপরের সাথে জড়িত তীর চিহ্নের মাধ্যমে দেখানো হয়েছিলো। যাই হোক, কোন পরিস্থিতিকে আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করি বা চিন্তা করি আমাদের অনুভূতি সেরকমই হয়, আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়াও সেরকম আর আমরা সেভাবেই আচরণ করি। প্রতিটি উপাদানই একে অপরকে প্রভাবিত করে। আমরা যদি একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করিযেমন আপনি কোন অনুষ্ঠানে নতুন কারো সাথে পরিচিত হলেন যে আপনার সাথে ভাল করে কথা বলল না – এই পরিস্থিতিকে আপনি কয়েকভাবেই দেখতে পারেন। যদি আপনি মনে করেন “লোকটা অভদ্র, ভালো করে কথাই বলল না” তাহলে আপনি হয়তো বিরক্ত হতে পারেন; যদি আপনি মনে করেন “ভদ্রলোক হয়তো আমাকে পছন্দ করেনি, আমিতো সবাইকে বোর করে ফেলি” তাহলে হয়তো আপনার মন খারাপ হবে, যদি আপনি মনে করেন “লোকটা লাজুক টাইপের, মেয়েদের সাথে কথা বলতে লজ্জা পায়” তাহলে হয়তো আপনি তার জন্য একটু মায়া অনুভব করবেন। তাহলে দেখা যাচ্ছে একই পরিস্থিতিকে আপনি যেভাবে চিন্তা করবেন আপনার অনুভূতি সেভাবেই তৈরী হচ্ছে। অনুভূতির সাথে শারীরিক প্রতিক্রিয়ারও সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনার মন খারাপ হলে শরীর নিস্তেজ লাগে, মনে হয় চলতে চায়না; আনন্দে থাকলে নিজেকে হাল্কা, ফুরফুরে লাগে; উত্তেজিত থাকলে শরীর টানটান থাকে; ভয় পেলে অতিরিক্ত সতর্ক থাকে। এইরকম প্রতিটি অনুভূতির সাথেই আমাদের শরীরের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যায়। শুধু অনুভূতিই নয় চিন্তার সাথেও আমাদের শরীরের প্রতিক্রিয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যার সহজ উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যৌন চিন্তা করলে মানুষ যৌন উত্তেজনা বোধ করে। সবশেষের উপাদানটি হলো আচরণ। যা কিনা আগের সবগুলো উপাদানের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে সম্পর্কীত। যেমনঃ আগের উদাহরণ অনুযায়ী আপনি যদি মনে করেন লোকটি অভদ্র আর তার প্রতি বিরক্ত বোধ করেন তাহলে হয়তো পরেরবার দেখা হলে আপনি নিজেই তাকে উপেক্ষা করবেন। যদি আপনি সবাইকে বোর করেন মনে করে মন খারাপ করেন তাহলে হয়তো পরেরবার কারো সাথে পরিচিত হতে চাইবেন না বা সেরকম অনুষ্ঠানেই যেতে চাইবেন না। আর যদি আপনি মনে করেন লোকটি মেয়েদের সাথে কথা বলতে অতিরিক্ত লজ্জা পায় তাহলে হয়তো আপনি তার সাথে নিজ উদ্যোগে কথা বলে তার অস্বস্তি কমিয়ে দিতে চাইবেন। আপনার আচরণ আবার আপনার পরিস্থিতির পরিবর্তন ঘটিয়ে দিবে। মজার না?
আমি বলেছিলাম বিশ্বাস কিভাবে লক্ষ্যবস্তু অর্জনে সহায়তা করে তার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা আলোচনা করব। তাহলে দেখা যাচ্ছে একজন মানুষ যখন নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখে তখন তার মনোভাব স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক হয় আচরণগুলোও নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী হয় তাই লক্ষ্য অর্জনও সহজ হয়। পজিটিভ চিন্তা করুন- এমন উপদেশ বা টিপস আমরা অহরহই শুনি। অনেক সফল ব্যাক্তির জীবনী পড়ে বা কথা শুনে দেখি তারা জীবন সম্পর্কে স্বভাবজাতই ইতিবাচক। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষদের প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জে, নতুন নতুন ব্যার্থতায় বা ব্যার্থতার ভয়ে ইতিবাচক চিন্তা ধরে রাখা কতখানি কঠিন তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি! তবুও দিন শেষে যদি কিছু ছোটখাট প্রাপ্তিকেও মূল্যায়ন করতে পারি, নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে পারি এবং পরের দিনটিকে নতুন সম্ভাবনার দিন হিসাবে শুরু করতে পারি সেটুকুই সার্থকতা!

রবিবার, ২৪ মার্চ, ২০১৩

ব্রেক আপ পরবর্তী সময়

সম্পর্কের মেয়াদ যেমনই হোক অল্প কিংবা বেশী, একটা সম্পর্কের বিচ্ছেদের পরবর্তী সময়টুকু পার করা আসলেই কষ্টকর। কিছুদিন আগে একটা ফোন পেলাম। অপরপ্রান্তে ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিলেন। বেশী সুবিধা হলো না, চিনতে পারলাম না। কিন্তু ভদ্রলোকের দাবী আরো কোন পরিচয় আছে যা শুনে আমি চিনতে পারব। সেদিন হাতে সময় না থাকায় কথা শোনার সুযোগ হয়নি। এরকম বেশ কয়েকবার হওয়ার পর সময় নিয়ে জানার চেষ্টা করলাম বিষয়টা আসলে কি। দেখা গেল পরিচয় আসলে নাই, তার পরিচিত হওয়ার ইচ্ছা। সম্প্রতি তিনি তার দীর্ঘদিনের একটি সম্পর্কের ইতি টেনেছেন। তাই একা একা লাগে, সময় কাটতে চায়না। বন্ধুরা পরামর্শ দিয়েছে কারো সাথে কথা বললে সময় ভালো কাটবে। সেজন্যই এই প্রচেষ্টা!

শুধু এই ঘটনাটিই নয় আমার অল্প সময়ের পেশাগত অভিজ্ঞতায় এইরকম বেশ কয়েকটি কেস দেখেছি। যেখানে ক্লায়েন্ট ব্রেক আপ পরবর্তী সময়ে অতিরিক্ত মানসিক চাপ, উদ্বেগ, বিষন্নতায় ভুগেন। কি করবেন বুঝে উঠতে পারেন না। অনেকে অতীত সম্পর্কে তাৎক্ষণিক মলম লাগাবার জন্য নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। বেশীরভাগ সময়ই নতুন এই সম্পর্কগুলির স্থায়ীত্ব বেশীদিন হয়না। কারণ তীব্র আবেগের চাপ, পুরানো প্রেমের স্মৃতি ভুলবার জন্য যে সম্পর্ক তৈরী হয় তার মজবুত ভিত্তি থাকে না। ফলাফলে উভয়ের মনেই ভালোবাসা, বিশ্বাস, আস্থা এই শব্দগুলির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব তৈরী হয়।

ত্রিশোর্দ্ধ বয়সী একজন ডিপ্রেশনের ক্লায়েন্ট দেখেছিলাম যিনি ডিভোর্স পরবর্তী ক্রাইসিসে ভুগছিলেন। তিনি আমার একজন সিনিয়রের পরিচিত। তিনি আমাকে ক্লায়েন্ট রেফার করার আগে ভদ্রমহিলাকে বলছিলেন "আপনিতো এই সময়ে অনেক মানসিক চাপের ভিতরে যাবেন, অনেকেই আসবে সান্ত্বনা দিতে, উপকার করতে,  কিন্তু এখনই যেন কোন সম্পর্কে জড়িয়ে পইড়েন না। অতিরিক্ত আবেগপ্রবণ থাকলে মানুষ সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারেনা"। এই ক্লায়েন্টকে দীর্ঘদিন দেখার সুযোগ আমার হয়েছিল। এইরকম সতর্কবার্তা শোনার পরও তিনি বছরখানেকে দু তিনটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়লেন এবং হুট করে আবার বিয়েও করে ফেললেন। যথারীতি সেই সম্পর্ক থেকেও প্রতারিত হলেন। তবে সেশনে আসার ফলে আগের মতো অতটা ভেঙ্গে পড়লেন না। নিজের আচরণের ফলাফলের দায়িত্বটুকু নিতে শিখেছিলেন।

আবার অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় যিনি সম্পর্ক ভুলতে নতুন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন, কিছুদিন পর মান-অভিমান মিটমাট হয়ে গেলে পুরানো সম্পর্কেই ফিরে যান। মাঝখান থেকে তৃতীয় ব্যাক্তি বলীর পাঠা হন। তারপর আবার সেই দিক থেকে এই দুষ্টচক্র শুরু হয়। অনেকে আবার এই প্রত্যাখ্যানটাকে এতো ভয়ংকর অভিজ্ঞতা হিসাবে নেন যে তিনি নতুন কোন স্থায়ী সম্পর্কে জড়াতেই পারেন না। জড়ালেও অপরপক্ষ ডাম্প করবে ভয়ে নিজেই সম্পর্ক ভেঙ্গে দেন।

আসলে খুবই সেনসিটিভ একটি সময়, ব্রেক আপ পরবর্তী সময়। সবাই প্রাণপণে চান দুঃসহ প্রতিটি মুহূর্তকে ভুলে থাকতে। আমরা প্রফেশনালরাও বলি খারাপ সময়গুলোতে আনন্দের, ভালোলাগার কাজে মনোযোগী হতে। কিন্তু নতুন সম্পর্কে জড়ানো কোন প্রকৃত সমাধান নয়। আবার এমনো নয় একটি সম্পর্ক ভাঙ্গার পর আপনি নতুন কোন সম্পর্কে জড়াবেন না। শুধু খেয়াল করুন আপনি ইমোশনালী স্টেবল কিনা, নতুন সম্পর্কের জন্য প্রস্তুত কিনা। আপনার উদ্দেশ্যটা আসলে কি? নতুভাবে নতুন করে জীবন্টাকে সাজানোর জন্য নতুন সম্পর্কের দিকে যাচ্ছেন নাকি শুধু পুরানো সম্পর্কের ভূত তাড়াতে চাইছেন। আপনার উদ্দেশ্যই আপনার সম্পর্কের সফলতা নির্ধারণ করবে। তা না হলে হয়তো আবারো আপনাকে সম্পর্কের জটিলতার অসুখী সমাপ্তির মুখোমুখী হতে হবে!

সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

সেলফ হিপ্নোসিসঃ কিভাবে করবেন

সেলহ হিপ্নোসিস কি এবং এর উপকারীতাগুলো কি কি সে বিষয়ে আগের লেখাতেই তুলে ধরেছিলাম। সেলফ হিপ্নোসিস কিভাবে করতে হয় তা লিখব কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। কথা দিয়ে কিছুটা বিপদে গেছি। আমি হিপ্নোসিসে অভিজ্ঞ কেউ বা হিপ্নোথেরাপিষ্ট নই, আপনাদের মতোই হিপ্নোসিসে কৌতুহলী একজন। তবে কৌতুহল নিবৃত্তে পড়াশোনা করছি। সেলফ হিপ্নোসিস করার পদ্ধতি ভালো করে পড়লাম, ভাবলাম প্রয়োগ না করে তো আর কাউকে করতে বলা যায়না, তাই একটু দেরী হয়ে গেলো। যাদের আগ্রহ আমার লেখার ইচ্ছেটা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে তাদেরকে ধন্যবাদ।

হিপ্নোথেরাপিষ্ট Tig Calvert এর মতে সেলফ হিপ্নোসিস শেখা খুবই সহজ এবং এটি একটি উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। যারা আগ্রহী এবং নিয়মিত অনুশীলন করে তারা সহজেই সেলফ হিপ্নোসিসে দক্ষ হতে পারবে।
হিপ্নোসিস অনুশীলন করার জন্য বেশীরভাগ মানুষই একটু নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করে। আরাম করে চেয়ারে বসে বা শুয়ে যে কোনভাবে করতে পারেন। তবে প্রথমদিকে শুয়ে করতে গেলে ঘুমিয়ে পড়বার সম্ভাবনা থাকে। যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তারা ঘুমের আগে শুয়েও অনুশীলন করতে পারেন।

হিপ্নোসিসে যে দক্ষতাগুলো কাজে লাগানো হয় তা হচ্ছে কল্পনা করা ও কল্পনায় ছবি তৈরী করা (Imagery and Visualization). অনেকে হয়তো ভয় পান তাদের কল্পনাশক্তি ততটা ভালো নয় কিন্তু হিপ্নোসিসে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। যতটুকু স্বাভাবিকভাবে আসে ততটুকুই যথেষ্ট এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি পাবে। সেলফ হিপ্নোসিসে যাওয়ার প্রক্রিয়ার কিছু ধাপ রয়েছে। যেমনঃ-
           ১। প্রথমে নিজের মনের অসচেতন অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। যেমনঃ আরাম করে বসে বা শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের প্রতি মনযোগ নিবদ্ধ করা। আরামদায়ক একটি অবস্থান তৈরী করা।
           ২। আনন্দাশ্রম তৈরী করা (the pleasant place):  আনন্দাশ্রম শব্দটি একটু কাব্যিক হয়ে গেলেও মোদ্দা কথা হচ্ছে আপনাকে আপনার পছন্দের একটি জায়গা কল্পনায় তৈরী করে নিতে হবে। যেখানে আপনি সবসময়ই নিরাপদ বোধ করেন।
           ৩। হিপ্নোসিসে প্রবেশের পদ্ধতি ব্যাবহারঃ হিপ্নোসিসে প্রবেশের অনেকগুলো পদ্ধতি আছে। যেমনঃ শারীরবৃত্তীয় ফিডব্যাক পাওয়ার মাধ্যমে(physiological feedback techniques), সংবেদী মাধ্যমে( sensory techniques), শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে(breathing techniques), চোখ নিবদ্ধকরণের মাধ্যমে (eye fixation techniques) ইত্যাদি।
            ৪। লক্ষ্য ঠিক করে নেয়াঃ হিপ্নোসিসের মাধ্যমে আপনি কোন কোন বিষয় গুলো নিয়ে কাজ করতে চান তা ঠিক করে নিতে হবে।

এখানে সংবেদীয় পদ্ধতির একটি স্ক্রিপ্ট বোঝার সুবিধার্থে তুলে ধরা হল

আমি নিজেকে আরামদায়ক অবস্থানে রাখি এবং নরম করে চোখ বন্ধ করি.........আমি আমার শরীরের অনুভূতির দিকে মনোযোগ দেই এবং সব দুঃশ্চিন্তাগুলাকে ছেড়ে দেই.........নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগী হই.........খুব স্বাভাবিকভাবে.........আমি খেয়াল করি আমার শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে.........প্রতিটি শ্বাস গ্রহণে আমি শিথিল অনুভব করছি.........আমি আমার কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে আরো শিথিল আরামদায়ক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারি.........আমি কল্পনা শুরু করি.........যেন গ্রামের পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছি.........পথে পথে হাটতে হাটতে বিশাল একটি দরজা দেখতে পাচ্ছি.........দরজার ওপাশে বিশাল মাঠ......... আমি দজা খুলে মাঠে প্রবেশ করছি.........আমি মাঠের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছি.........মাঠের সবুজ গালিচার মতো ঘাস দেখছি............মৃদুমন্দ বাতাস আমার শরীরে বুলিয়ে যাচ্ছে............আমি আকাশের দিকে দেখছি.........আকাশের রঙ দেখছি.........পরিস্কার নীল আকাশ.........মাঝে মাঝে কিছু সাদা মেঘের ভেলা......আমি মাঠের মাঝে বিশাল একটা বেলুন দেখতে পেলাম যেগুলো মানুষ বহন করে.........আমি ধীরে ধীরে সেই বেলুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি.........কাছে গিয়ে দেখি বেলুনের মানুষ বহনের ঝুড়িটি মাটির সাথে লাগানো এবং বেলুন থেকে আগুনের স্ফুলিংগ ছড়িয়ে পড়ছে যে ন তা আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত.........খুবই চমৎকার একটি দৃশ্য.........আমি বেলুনের এই ঝুড়িটিতে বসে উত্তেজনাকর একটি ভ্রমণে অংশ নিতে পারি.........আমি ঝুড়িটিতে উঠে বসছি......ঝুড়িটির ভেতরটা খুবই আরামদায়ক.........বসার ব্যবস্থা চমতকার......নিজেকে নিরাপদ অনুভব করছি......বেলুনটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু কররেছে......আমি বেলুনটিকে মাটি থেকে উপরে উঠতে দেখছি......গরম বাতাস অনুভব করছি.........ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছি......পৃথিবীর সকল কোলাহল ও ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে......সুদূর নীলাকাশে.........আমি আমার শ্বাস প্রশ্বাস খেয়াল করছি......খুব স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিচ্ছি ও ছাড়ছি.........প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের সাথেসাথে বেলুনটি আরো উপরে উঠে যাচ্ছে......আরামদায়কভাবে আরো উপরে উঠে যাচ্ছে.........প্রতিটি নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে আমি আমার সকল দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হচ্ছি.........নিজেকে অনুভব ও উপভোগ করার সুযোগ দিচ্ছি.........বেলুনটি আরো উপরে উঠে যাচ্ছে, আরো উঁচুতে, আরো  উঁচুতে.........আর নিজেকে আরো হালকা অনুভব করছি, আরো হালকা............আমার সারা শরীর ভাসছে............আমি বেলুনটিকে যত খুশী উপরে নিয়ে যেতে পারি.........আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে .........আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরবাড়ীগুলো, রাস্তাগুলো, মাঠ, নদী সব দেখতে পাচ্ছি.........নিজেকে হালকা অনুভব করছি.........  আমার কল্পনাই আমাকে এই ভ্রমণে নিয়ে যাচ্ছে.........এবং নিজেকে হালকা এবং স্বাধীন অনুভব করছি............আমি যেখানে খুশী যেতে পারি .........আমার সেই বিশেষ আনন্দের জায়গাটিতেও.........আমার আনন্দাশ্রমে.........

তাহলে এইবার আপনিও হিপ্নোসিস অনুশীলন করে দেখতে পারেন। তবে প্রশ্ন একটি রয়েই যাচ্ছে। হিপ্নোসিস যে হলো আপনি বুঝবেন কি করে? হিপ্নোসিস অবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। যেমনঃ

১। চোখের পাতা কাঁপা এবং চোখ দ্রুত নড়াচড়া করা
২।শ্বাস প্রশ্বাসের হার পরিবর্তন হওয়া সাধারণত ধীরে ধীরে এবং গভীরভাবে নিঃশ্বাস হওয়া
৩। অনিয়ণত্রিতভাবে মাংশপেশীর কাঁপুনি দেখা যায়
৪।অংগপ্রত্যংগ বেশ ভারী অনুভব করা বা খুব হালকা অনুভব করা। ব্যাক্তিভেদে অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে।
৫।বসে অনুশীলন করলে মাথাটা নুয়ে পড়া, মুখভঙ্গি শিথিল হয়ে যাওয়া, হাল্কা নাক ডাকা, নড়াচড়া করতে না পারা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, পেটের ভিত সুড়সুড়ি দেওয়া, শরীরে চুলকানী অনুভব করা, হার্টবিট জোরে জোরে শুনতে পাওয়া
৬।অন্য সময়ে যে শব্দগুলোকে আলাদাভাবে শোনা যেতনা সেগুলো জোরে শুনতে পাওয়া। যেমনঃ ঘড়ির টিক টিক
৭।সময় সম্পর্কে ভুল ধারণা লাভ। যেমন কয়েক মিনিটকে ঘন্টার মতো মনে হওয়া
৮।ক্ষুধা, তৃষ্ণা লোপ পাওয়া, চোখ খুলতে না পারা
৯। উদ্বেগ কমে যাওয়া, শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা
১০। আনন্দের স্মৃতিগুলো স্বতঃস্ফুর্তভাবে মনে পড়া, নিজেকে সুখী অনুভব করা ইত্যাদি।

সবাই যে সবগুলো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাবেন তা নয়। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

কিছুটা প্রত্যাশার চাপ নিয়েই লেখাটা লিখতে বসেছিলাম। জানিনা কতটুকু সহজভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। আমি নিজেও অনুশীলন করছি, আপনাদের করো কাজে লাগলে ভালো লাগবে। 

বুধবার, ১৩ মার্চ, ২০১৩

সেলফ হিপ্নোসিস!!!

আগের লেখাতে হিপ্নোসিস সম্পর্কে আমাদের ভুল ধারণাগুলো আলোচনা করা হয়েছিল। আজকের লেখায় সেলফ হিপ্নোসিস সম্পর্কে জানব। কি? সেলফ হিপ্নোসিস নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেছেন? গল্প, নাটক, সিনেমাতে তো সবসময় দেখে এসেছি চোখের সামনে পাগল কোন মনোবিজ্ঞানী একটা পেন্ডুলাম জাতীয় জিনিস ঘুরায় আর অপরজন সম্মোহিত হয়, তাহলে সেলফ হিপ্নোসিস আবার কি জিনিস! তাই ভাবছেন? হুমম, তাহলে সেলফ হিপ্নোসিস বিষয়টাই প্রথমে জেনে নেই। আমরা যখন কাউকে হিপ্নোটাইজ করতে দেখি তখন তিনি আসলে ব্যাক্তিকে গাইড করে তার সচেতন মানসিক অবস্থা থেকে শিথিল একটি অবস্থানে নিয়ে যান। হিপ্নোসিস সচেতন মানসিক অবস্থার একটি বিপরীত অবস্থা (an altered state of consciousness)। সেলফ হিপ্নোসিসে ব্যাক্তি নিজেই এই কাজটি করেন। ব্যাক্তি নিজেকেই গাইড করে সেরকম একটি অবস্থায় নিয়ে যায় যেখানে তার ডিফেন্স মেকানিজমগুলো শিথিল হয়ে যায়। ডিফেন্স মেকানিজম একজন ব্যাক্তিকে সমাজ যে বিষয়গুলো অনুমোদন করেনা সে রকম চিন্তাগুলো আসতে বাঁধা দেয়। ডিফেন্স মেকানিজম অনেক ধরনের হয়। সে বিষয়ে অন্য আরেকদিন কথা বলা যাবে। মূল বিষয় হচ্ছে ডিফেন্স মেকানিজম অতিরিক্ত ব্যাবহার করলে মানসিক চাপ বৃদ্ধি পায়। সেলফ হিপ্নোসিসে ব্যাক্তির ডিফেন্স মেকানিজম প্রক্রিয়া শিথিল হয়ে যায়।  ফলে যে চিন্তাগুলো সচেতনভাবে ব্যাক্তির ভিতরে প্রবেশ করতে পারতোনা সেই চিন্তাগুলো সম্পর্কেও অন্তর্দৃষ্টি লাভ করে যা কিনা অনেক সমস্যা সমাধানের টনিক হিসাবে কাজ করে।

তো এই সেলফ হিপ্নোসিস সম্পর্কে আমাদের জেনে আসলে কি লাভ? সেলফ হিপ্নোসিস কেন করব? সেলফ হিপ্নোসিসের উপকারীতা আসলে অনেক। অনেকেই নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণের জন্য সেলফ হিপ্নোসিস করে থাকেন। আত্মমর্যাদাবোধ, আত্মবিশ্বাস, কাজের প্রেরণা, সৃজনশীলতা প্রভৃতি বৃদ্ধি বা উন্নত করার জন্যও অনেকে সেলফ হিপ্নোসিসকে বেছে নেন। এছাড়াও মানসিক চাপ ও উদ্বেগ কমাতেও সেলফ হিপ্নোসিস খুবই সহায়ক ভূমিকা পালন করে। যার ফলে ব্যাক্তি দৈনন্দিন জীবনে নেতিবাচক আবেগগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে চাপ সহজেই মোকাবেলা করতে পারে।

তাহলে দেখা যাচ্ছে সেলফ হিপ্নোসিস আমাদের অনেক কাজেই লাগে! তাহলে সেলফ হিপ্নোসিস কিভাবে করা যায় সেই কৌতুহল জাগা স্বাভাবিক। এই কৌতুহল রেখেই আজকে শেষ করি। আগামি লেখায় আমরা সেলফ হিপ্নোসিস কিভাবে করতে হয় তা জানবো।

বুধবার, ৬ মার্চ, ২০১৩

এই যাদুটা যদি সত্যি হয়ে যেতো!


"এই যাদুটা যদি সত্যি হয়ে যেতো, তাহলে আমি তা শিখে নিতাম, প্রথমেই আমি তাকেই যাদু করতাম!" প্রখ্যাত সংগীত শিল্পী সামিনা ,চৌধুরীর এই গানটি আমার অন্যতম প্রিয় একটি গান। মানোবিজ্ঞানী হওয়ার পেছনেও অন্যকে ভালো করে বোঝার, জানার, হয়তোবা যাদু করার সুপ্ত ইচ্ছাও ছিলো! কারণ সাইকোলজিষ্ট বললেই কমন যে প্রশ্নগুলো শুনতে হয় তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে "আপনি কি হিপ্নোসিস জানেন? ওই যে চোখের সামনে গোল জিনিস নাড়াতে নাড়াতে ঘুম পাড়িয়ে দেয়, আপনি পারেন?" উত্তরে না বললেই অপর ব্যাক্তির সকল আগ্রহ উধাও। যেন হিপ্নোসিস না জানলে আর কি সাইকোলজিষ্ট হলাম! তাই মনে মনে সবসময়ই হিপ্নোসিস শেখার একটা আগ্রহ কাজ করতো। তো সেই সুযোগও এসে গেল। গত ১৩ই ফেব্রুয়ারী, ২০১৩ প্রফেসর মাহমুদুর রহমান স্যার ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি ডিপার্টমেন্টে সম্মোহন (hypnosis)-এর উপর একটি introductory workshop করালেন। দেখা গেলো শুধু আমারই নয় অধিকাংশ অংশগ্রহনার্থীর ভেতরেই বিশেষ কাউকে যাদু করার ইচ্ছা প্রবল। ছেলেরা একটু ভয়ই পেলো কারণ মেয়ে সাইকোলজিষ্টের সংখ্যা বেশী। একদিনেই হিপ্নোসিস শিখে ফেলার জন্য আমরা সকলেই খুব উদ্গ্রীব ছিলাম। হিপ্নোসিস কি, এই বিষয়ে আমরা কি জানি, মাহমুদুর রহমান স্যারের এই সকল প্রশ্নের উত্তরে দেখা গেলো আমাদের এই প্রফেশনাল গ্রুপের ভেতরেও হিপ্নোসিস সম্পর্কে অনেক ভুল ধারণা রয়ে গেছে যা কিনা সাধারণ মানুষদের মতোই। হিপ্নোসিস সম্পর্কে সাধারণতঃ যে ভুল ধারনাগুলো পোষণ করা হয় সেগুলো নিম্নরূপঃ

           ১।হিপ্নোসিস অনেকটা যাদুর মতোঃ- হিপ্নোসিস খুব স্বাভাবিক একটি অবস্থা (natural state)। এতে যাদুর কিছু নেই।হিপ্নোসিস সচেতন মানসিকতার বিপরীত একটি অবস্থা (an altered state of consciousness)।
           ২। হিপ্নোসিস করার সময় ব্যাক্তি ঘুমিয়ে থাকেঃ- সম্মোহন থাকাকালীন সময়ে ব্যাক্তি অনেক রিলাক্স থাকে কিন্তু ঘুমিয়ে নয়।
           ৩। হিপ্নোসিস খুব বিপদজনকঃ-  হিপ্নোসিস নিজে কোন বিপদজনক কিছু নয় তবে যারা হিপ্নোসিস করেন তাদের কিন্তু সতর্কতার প্রয়োজন রয়েছে। উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ছাড়া কাউকে হিপ্নোটাইজ করার চেষ্টা করা উচিত নয়।
           ৪। কাউকে সম্মোহন করলে সে এমন কিছু করে বা বলে যা সে আসলে প্রকাশ করতে চায়নাঃ-  এটিও খুব কমন একটি ভুল ধারনা। কারণ সম্মোহিত থাকা অবস্থায়ও ব্যাক্তির নিজস্ব নিয়ন্তণ বজায় থাকে। এই ভুল ধারণা তৈরী হওয়ার পিছনে stage hypnosis-এর ভূমিকা রয়েছে। সেখানে ব্যাক্তিদেরকে অনেক হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়। কিন্তু stage hypnosis আর চিকিৎসাতে ব্যবহৃত হিপ্নোথেরাপী এক নয়।
           ৫। সম্মোহিত অবস্থায় ব্যাক্তি অন্যের নিয়ন্ত্রণে থাকেঃ-  সম্মোহিত অবস্থায় ব্যাক্তি সবসময়ই নিজের নিয়ন্ত্রণে থাকে।  সম্মোহিত অবস্থায় কখনোই কাউকে জোর করা যায় না। হিপ্নোথেরাপীতে একজন প্রফেশনাল শুধু এই প্রক্রিয়াটি ব্যাবহার করেন ক্লায়েন্টের কাংখিত কিছু পরিবর্তন আনার জন্য।

কি হতাশ হয়ে গেলেন? আপনার ভেতরেও এই ভুল ধারণাগুলোর কোন একটি নিশ্চয়ই ছিলো? আমারো ছিলো। যদিও হিপ্নোসিস শিখে বাড়ী ফিরতে পারিনি তবে ওয়ার্কশপ শেষে হিপ্নোসিস সম্পর্কে সঠিক ধারণাগুলো জেনেছি। একদিন হিপ্নোসিসও শিখবো!

শনিবার, ২ মার্চ, ২০১৩

প্যানিক ডিসঅর্ডারে করণীয়

প্যানিক ডিসঅর্ডার বিষয়টা কি তা আগের লেখাতেই আলোচনা করেছিলাম। এই রোগে প্যানিক অ্যাটাককেই হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ ভেবে অনেকে ভুল করেন। আজকে আমরা প্যানিক ডিসঅর্ডারে নিজেরা কোন কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারি তা জানব। তবে মজার কথা হচ্ছে এই সমস্যায় সবচেয়ে কঠিন দিকটি হলো ক্লায়েন্ট কে রোগটি যে মানসিক তা accept করতে সাহায্য করা। কারণ ব্যাক্তি অনেক সময় এতো তীব্রভাবে লক্ষণগুলো অনুভব করে যে তার কাছে অবিশ্বাস্য মনে হয় লক্ষণগুলো শারীরিক নয় মানসিক কারণে সৃষ্ট। আপনার diagnosis যদি প্যানিক ডিসঅর্ডার হয় তাহলে এই সত্য আপনি যত দ্রুত স্বীকার করে নেবেন আপনার সমস্যা থেকে বের হয়ে আসা ততখানি তাড়াতাড়ি হবে।

ভেবে দেখুন আপনার হার্টবিট যদি হঠাৎ করেই তীব্রভাবে বেড়ে যায়, আপনার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে, শরীর কাঁপতে থাকে, মনে হয় এখুনি বুঝি মরে যাবো, তাহলে ভয় পাবেন কিনা? ভয় পাওয়াটা স্বাভাবিক। একবার এরকম হলে আবার হতে পারে সেই ভয়ও কিন্তু কাজ করে। এরকম ভয় থেকে অনেকে কিন্তু নিরাপত্তার জন্য কিছু আচরণ করে থাকেন। যেমনঃ বাড়ীর বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেওয়া, একা একা না থাকা, সঙ্গে সবসময় কাউকে রাখা, লক্ষণগুলো শুরু হতে নিলেই কোন ওষুধ খেয়ে নেওয়া ইত্যাদি। যার ফলে ব্যাক্তি সেই দুষ্ট চক্রের ভিতরেই থাকে, সমস্যা থেকে বের হয়ে আসতে পারেনা। এখন আপনি ঠিক করুন, আপনি এই নিরাপদ আচরণগুলো যা আপনার সমস্যাকে জিইয়ে রাখে সেগুলো আপনি করবেন কিনা? আমি জানি এই পদক্ষেপটা নেয়া আপনার জন্য অনেক কঠিন। চেষ্টা করুন, যদি একান্তই অসম্ভব মনে হয় প্রফেশনাল কারো হেল্প নিন।

এছাড়াও এই সমস্যার কারণে যেসব পরিস্থিতিগুলো আগে এড়িয়ে যেতেন এখন থেকে সেসব পরিস্থিতির মুখোমুখি বেশী বেশী করে হোন। যখন লক্ষণগুলো শুরু হতে নিবে তখন শিথিলায়ন (relaxation) করার চেষ্টা করুন, নিঃশ্বাস ধীরে ধীরে নিন কিছুক্ষণ ধরে রেখে ধীরে ধীরে ছাড়ুন। নিজেকে বলুন এই লক্ষণগুলো খুব বেশী সময় ধরে তীব্রভাবে থাকবে না, ধীরে ধীরে কমে যাবে, আমি এই কঠিন সময়টাও পার করতে পারবো। গান শুনুন, যা ভালো লাগে সেই কাজে মনোনিবেশ করুন বা যা করছিলেন তাই চালিয়ে যান, দেখবেন ধীরে ধীরে লক্ষণগুলো এমনিতেই কমে আসবে। এভাবে প্যানিক অ্যাটাকের ঘটনাও কমে যাবে।

বৃহস্পতিবার, ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আমার হার্ট অনেক দুর্বল!!!



"আমার হার্ট অনেক দুর্বল। মাঝে মধ্যেই আমার হার্টবিট অনেক বেড়ে যায়। মানে বুকে ধড়ফড় শুরু হয় আরকি। মনে হয় নিজের উপর আর কোন নিয়ন্ত্রণ নাই, মাথা ঘুরে পড়ে যাবো। সারা শরীর কাঁপতে থাকে। প্রচুর ঘাম হয়। বুকের ভেতর কেমন যেন লাগে। দম বন্ধ হয়ে যায়, নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয়, মনে হয় এখনি মরে যাবো। হার্টের অনেক ভালো ভালো ডাক্তার দেখিয়েছি। কেউ কিছু ধরতে পারে নাই। মানসিক রোগের এখানে কেন যে পাঠালো আমি তো বুঝতে পারছিনা। আমি কি পাগল হয়ে যাচ্ছে নাকি?"

আপনি যদি এই ধরনের লক্ষণ নিয়ে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে রেফার হয়ে আসেন তাহলে আপনার মনে এই প্রশ্ন জাগাই স্বাভাবিক। শুধু আপনিই নন এই সমস্যার বেশীরভাগ ক্লায়েন্টই কার্ডিয়াক ডিপার্টমেন্ট থেকে, অনেকেই এই প্রচুর টেস্ট করান, এক ডাক্তার থেকে আরেক ডাক্তারের কাছে ঘুরে বেড়ান। কারণ হার্টবিট এতো তীব্রভাবে বেড়ে যাওয়াকে অনেকেই ভয় পেয়ে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ বলে মনে করেন। ডাক্তার যখন বলেন, " আপনার হার্ট সুস্থ আছে, কিছু হয়নি, তখন ক্লায়েন্ট মনে করেন ডাক্তার তার রোগ ধরতে পারেনি। আসলে আপনি যে লক্ষণগুলোকে হার্ট অ্যাটাকের লক্ষণ বলে ভাবছেন তা প্যানিক অ্যাটাকের লক্ষণ। আর প্যানিক অ্যাটাক যদি অপ্রত্যাশিতভাবে হয় কোনরকম কারণ ছাড়াই এবং ব্যাক্তির ভিতরে যদি অতিরিক্ত ভয় তৈরি হয় আবার এই রকম অ্যাটাকের মুখোমুখি হবার, যার ফলে ব্যাক্তির স্বাভাবিক জীবনযাপন হুমকীর সম্মুখীন হয় তাকে প্যানিক ডিসঅর্ডার বলে। প্যানিক ডিসঅর্ডার একটি মানসিক রোগ। সে কারণেই আপনাকে সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে রেফার করা হয়েছে। আর সাইকিয়াট্রি ডিপার্টমেন্টে আসা মানেই পাগল হয়ে যাওয়া নয়। মন ও মস্তিস্কের অধিকারী হলে মানসিক বিভাগে কখনো কখনো ঢুঁ মারাটা স্বাভাবিক।

কি? নিজেকে বোকার মতো মনে হচ্ছে? ভুল কিন্তু আপনার নয়। অনেক সময় ডাক্তারদেরও সময় লাগে লক্ষণগুলো শারীরিক না মানসিক বোঝার জন্য। সুতরাং আপনি বিভ্রান্ত হতেই পারেন। কিন্তু লক্ষণগুলো যে মানসিক হতে পারে যখন আপনি স্বীকার করে নেবেন তখনই আপনার সমস্যা থেকে বের হয়ে আসার সম্ভাবনা অনেকগুণ বেড়ে যাবে।

 প্যানিক ডিসঅর্ডারে অনেক সময়ে ব্যাক্তি প্যানিক অ্যাটাকের ভয়ে বাড়ির বাইরে যাওয়া কমিয়ে দেয় বা মানুষজনের ভীড় এড়িয়ে চলে, একে বলা হয় প্যানিক ডিসঅর্ডার উইথ অ্যাগোরাফোবিয়া। এই মানসিক রোগটি সাইকোথেরাপীতে অনেক ভালো কাজ করে। প্যানিক ডিসঅর্ডারে প্রফেশনাল হেল্প পাওয়ার সুযোগ না থাকলে আমরা নিজেরা নিজেরা কোন কোন বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে পারি তা আগামী লেখায় পড়বো!



মঙ্গলবার, ২৬ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

আজকে একবার খাই, কাল থেকে আর খাবনা!!!

কৌতুহল থেকে নেশার জগতে জড়িয়ে পড়ার পর এর ক্ষতিকারক দিক সম্পর্কে সবাই যে বুঝতে পারেনা তা কিন্তু নয়। অনেকেই বোঝেন, মনে মনে ঠিক করেন আর করবেন না, তারপরও দেখা যায় আবার করছেন। কিভাবে এই দুষ্ট চক্র চলতে থাকে? মাদক গ্রহণের এই আচরণটি সম্পর্কে প্রত্যেকেরই নিজস্ব কিছু বিশ্বাস থাকে। যেমনঃ অনেকে মনে করেন গাঁজা তেমন ক্ষতিকর নেশাদ্রব্য নয় বা মাঝে মাঝে করলে আসলে তেমন কিছু হয় না। যারা দীর্ঘদিনের মাদকসেবী তাদের জন্য একেবারেই কিছু নেবনা এমন চিন্তা করাটা অসম্ভব মনে হয়। অনেকে হয়তো ভেবে রাখেন যে দিনে এক স্টিক গাঁজা খাবেন বা শুধু অ্যালকোহল নিবেন। অনেকে শুধু উৎসবের দিনগুলোতে করার ইচ্ছা মনে মনে পুষে রাখেন। যার ফলে নেশার সাথে তাদের মানসিক বন্ধনটা ছিন্ন হয় না। ফলে যখন কোন ঝুঁকিপূর্ণ পরিস্থিতি তৈরী হয় তখন তা মোকাবেলা করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। যেমনঃ চাঁদ রাত, ঈদের দিন, পহেলা বৈশাখ বা বন্ধুদের সাথে যে কোন কিছু সেলিব্রেট করার জন্য আমন্ত্রণ পান তখন দৃঢ়ভাবে না করা সম্ভব হয় না। আর নিজেরো যেহেতু ধারণা একদিন খেলে কিছু হয়না তাই নিজেকে ছেড়ে দেন "আজকে খাই, কাল থেকে আর খাব না"। কিন্তু এই নিয়ন্ত্রণটা ধরে রাখা সম্ভব হয় না। দেখা যায় পরদিন আবার খেতে ইচ্ছা করলো হুট করে মনে হলো আজকেই একবার খাই আর খাব না। আর উৎসবেরও এখন কোন অভাব নাই। আজকে অমুক তো কালকে আবার অমুক দিন। ফলে এভাবেই দুষ্ট চক্র চলতে থাকে আর ব্যাক্তি ধীরে ধীরে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে।

অ্যালকোহল নির্ভরশীলদের জন্য যেমন রয়েছে অ্যালকোহল অ্যানোনিমাস বা AA নামে সেলফ হেল্প গ্রুপ তেমনি মাদকে নির্ভরশীল ব্যাক্তিদের জন্যও আছে নারকোটিক অ্যানোনিমাস বা NA গ্রুপ। এই গ্রুপগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য স্লোগান হলো "আজকের দিনের জন্য বেঁচে থাকো" (One day at a time). এই স্লোগান কাজে লাগিয়ে অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে মাদকমুক্ত আছেন।

আজকে খাই কালকে থেকে আর খাবনা - এই চিন্তা থেকে সরে এসে যদি আজকের দিনের জন্য ড্রাগস ফ্রি থাকবো এভাবে চিন্তা করতে শিখি তাহলে এই দুষ্ট চক্র ভেঙ্গে বেড়িয়ে আসা কিছুটা হলেও সহজ হবে।

রবিবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

কৌতুহল ও মাদক নির্ভরশীলতা

মানুষ মাত্রই কৌতুহলী। মানুষ মাত্রই নতুন কিছু জানতে চায়, বুঝতে চায়, পরীক্ষা করে দেখতে চায়। মানব সভ্যতা বিকাশে কৌতুহলের ভুমিকা অপরিসীম। কিন্তু এই কৌতুহলই আবার কখনো কখনো বিপদজনক হয়ে দাঁড়ায়। যখন তা মাদকের প্রতি দেখানো হয়। অধিকাংশ মাদক নির্ভরশীল ব্যাক্তি কৌতুহলী হয়েই এই পথে পা বাড়ান। উঠতি বয়সে সিগারেট দিয়ে শুরু করে তারপর কিছুদিন পরে গাঁজার প্রথম টান। বন্ধুদের কাছে শোনা গল্প বা খাওয়ার  পর কেমন লাগে তা জানার জন্যই কৌতুহলের বশবর্তী হয়ে টান দেয়া হয়। অ্যামেরিকান একটি গবেষণায় দেখা গেছে প্রায় শতকরা ৫ থেকে ১৯ ভাগ অনুর্দ্ধ ১৯ বছরের কিশোরেরা গুরুতর মাদকাসক্তির সমস্যায় আক্রান্ত হয় যার প্রথাগত চিকিৎসার প্রয়োজন পড়ে। বাংলাদেশও পরিস্থিতি আশংকাজনকভাবে অবনতি ঘটছে। স্বরাস্ট্র মন্ত্রণালয় পরিচালিত জরীপ অনুযায়ী সারাদেশে মাদকাসক্তের হার প্রায় ৪৬ লাখ, কোন কোন সূত্র অনুযায়ী তা ৭০ লাখের বেশী। এর মধ্যে ৯১ শতাংশই কিশোর ও যুবক। কিশোর বয়সে কৌতুহল থাকে বেশী এবং প্রলোভন নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা থাকে কম। ফলে বন্ধুদের দ্বারা বা বন্ধুদের কাছ থেকে শোনা তথ্য দ্বারা প্রভাবিত হয় সহজেই। অধিকাংশ মাদকসেবী বিষ্যটি যেভাবে উপস্থাপন করেন তা হলো "মনে হইলো একটু খেয়ে দেখি কেমন লাগে, অনেক তো শুনছি"। ১৭ বছর বয়সী একজন ক্লায়েন্ট বলেছিলেন " আমার জীবনের একটা ফান্ডা হইলো সবকিছু ট্রাই করমু, যতরকম নেশা আছে সব একবার খেয়ে দেখমু"। সবগুলো দেখতে হয়নি ইয়াবাতে এসেই জড়িয়ে পড়লেন এবং সেই সময় একটি রিহ্যাবিলিটেশন সেন্টারে ভর্তি ছিলেন। জীবন সম্পর্কে অতিরিক্ত অ্যাডভেঞ্চার ও কৌতুহলী মনোভাব তাকে এই পরিস্থিতির মুখোমুখী দাঁড় করিয়েছিলো।  'ও' লেভেল পরীক্ষার্থী ছিলেন সে বছর মিস করলেন। প্রথমে কৌতুহল থেকে নেওয়া হয়েছে, তা থেকে উদ্ভূত সমস্যার ফলে পরে হতাশা থেকে নেওয়া হয়। এভাবে ব্যাক্তি মাদকের নির্ভরশীলতার জালে জড়িয়ে যায়। সুতরাং আমরা যেন আমাদের জন্য ক্ষতিকর এমন কৌতুহল থেকে নিজেকে বিরত রাখতে পারি এবং এ বিষয়ে বন্ধুদের মাঝে সচেতনতা তৈরী করতে পারি। মাদকগ্রহণ সংক্রান্ত যে কোন বিষয়ে বন্ধুদের চাপ যেন অগ্রাহ্য করতে পারি।