“মাইশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করে
চাকুরীজীবনে প্রবেশ করেছে। বয়স ২৭, দেখতে চলনসই। কিন্তু এখনও একা। ভালোলাগেনি কখনও
কাউকে তেমন নয়, ভালোলাগার কথা বলা হয়নি। ভালোলাগার কথা বলেনি যে কেউ তেমনও নয়,
ভালোবাসার সম্পর্কে নিজেকে জড়ানো হয়নি। পড়শোনায় বুদ্ধিমতি, লক্ষ্মী, বাধ্যগত মেয়ে
হিসাবে মাইশার পরিবারে সুনাম আছে। সেই সুনাম ধরে রাখার জন্য সবসময়ই একটা মানসিক
চাপ বোধ করে। মাইশার ছোটবেলাতেই তার বাবা মাকে ছেড়ে চলে যায়। মাইশা তার মার সাথে
নানাবাড়ী থাকে। লক্ষ্মী মেয়ে হিসাবে সুনাম ধরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টার সেটাও একটা
কারণ। মাইশার কেবলই মনে তার যে কোন ভুলকেই তার বাবা মার ডিভোর্সের ব্যাপারটিকে
তুলে ধরবে, যে বাবা মা আলাদা থাকে বলে ছেলেমেয়ে ঠিকমতো মানুষ হয়নি! তাই ভুল করার
ঝুঁকি মাইশা কখনই নিতে চায়না। কাউকে ভালো লাগলে, কোন সম্পর্কে জড়ালে তার ফলাফল
কেমন হবে তার হিসাবটা অংকের মতো সুনির্দিষ্ট নয় বলে এই বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে চায়না।
কখনও একা লাগেনা তা না, অস্থির লাগেনা তা না, কখনো যে মনে হয়না যে পৃথিবীতে কেউ
তাকে ভালোবাসেনা তাও না, কিন্তু এই অনুভূতিগুলোর কথা মাইশা কাউকে বলতে পারেনা।
কাউকে ভালবাসলে হয়তো আরো বেশী কষ্ট পেতে পারে, ভালোবাসার মানুষ তাকে ছেড়েও চলে
যেতে পারে এই ভয়ে মাইশা যে কোন সম্পর্কের হাতছানি থেকেই দূরে সরিয়ে নেয়। চাকুরী,
ক্যারিয়ারের দিকে মনযোগী হয়। তাই অন্যদের চোখে মাইশা অ্যাম্বিশাস ও প্রাক্টিক্যাল
একজন মানুষ। যার ফলে ভালো লাগার কথা বলা মানুষদের সংখ্যাও কমে যেতে থাকে, মাইশা
আরো বেশী একা হয়ে যেতে থাকে।”
হয়তো খুব বেশী নয় কিন্তু মাইশার মতো অনেকেই
আছেন যারা ভালোবাসতে ভয় পান। আমার এই অল্প দিনের অভিজ্ঞতাতেই এইটুকু দেখার সুযোগ
হয়েছে যে আবেগীয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে আবেগের সহজ বহিঃপ্রকাশ আসলে কতটা কঠিন!
কোথাও পড়েছিলাম দেশের জনগণকে ভালোবাসা সহজ কিন্তু প্রতিবেশীকে ভালোবাসা
কঠিন! তার মানে হচ্ছে অনেক মানুষের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করা সহজ হলেও নির্দিষ্ট
কারো প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা প্রকাশ করা কঠিন। সম্পর্কের ক্ষেত্রেও অনেক রকম
হিসেব নিকেশ কাজ করে। অনেকেই প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয়ে অনুভূতির কথা প্রকাশ করতেই ভয়
পান, আবার অনেকেই আছেন যারা সম্পর্কের ভেতরেও নিয়ন্ত্রণ হারাবার আতংকে থাকেন। তারা
ভালোবাসতে ভয় পান। মনে করেন সঙ্গী যদি বুঝে ফেলে যে তিনি বেশী দুর্বল তার প্রতি
তাহলে হয়তো বেশী সুযোগ নিবে বা কোন কারণে সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলে অনেক বেশী কষ্ট
পাবেন! এই ভয় শুধু বিয়ের আগেই নয় বিয়ের পরেও অনেক দম্পতির ভিতরে কাজ করে। একবার এক
ক্লায়েন্ট আমাকে তার স্ত্রী সম্পর্কে বলছিলেন। যখন আমি তার কাছে জানতে চাইলাম তিনি
তার অনুভূতির কথা তার স্ত্রীকে বলেছেন কিনা। তখন তিনি বললেন “না বলি নাই। বললে তো
বুঝে যাবে যে ওরে ছাড়া আমি থাকতে পারবনা। তখন নিজের জিদ বেশী রাখব, আমার কথা শুনতে
চাইবনা”।
কেউ কেউ আবার সম্পর্কের ক্ষেত্রে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হতে ভয় পান। তার পেছনেও
অনেক সময় পরবর্তীতে কষ্ট পাওয়ার ভয় বা ভালোবাসলে বেশী ভালোবাসার ভয় কাজ করে। কেউ
কেউ হয়তো একবার কষ্ট পেয়েছেন সেখান থেকে শিক্ষা নিয়েছেন এরপর আর কাউকে মন দিয়ে
ভালোবাসবেন না! বা তেমন সিরিয়াসলি সম্পর্কে জড়াবেন না! সেক্ষেত্রে এই জাতীয়
কথাগুলো খুব বেশী শোনা যায়-
“সত্যিকার ভালোবাসছিলাম, বুঝলনা। চলে গেল। তখন থেকেই ঠিক করছি আর কাউকে
সিরিয়াসলি ভালোবাসব না। ধরব আর ছাড়ব”। বা
“ছেলেদেরকে বিশ্বাস করা বোকামী, ওদের মন মুহুর্তেই ঘুরে যায়। প্রেম করলে
অসুবিধা নাই, বিয়ে বাবা মার পছন্দে করাই ভালো”
তাই অনেকই সাবধানতা বজায় রেখে (Safety
behavior) ভালোবাসতে পছন্দ করেন। যেন সম্পর্ক ভেঙ্গে গেলেও মনে বেশী কষ্ট না পান।
মজার ব্যাপার হল এই সাবধানতাই বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে সম্পর্ক ভাঙ্গার অনুঘটক হিসেবে
কাজ করে। কারণ এই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যই অনেকে সম্পর্কে কিছুটা দূরত্ব বজায়
রাখেন, পারস্পরিক আস্থা ও বিশ্বাসের ঘাটতি থেকে যায়। সম্পর্কের নিয়ন্ত্রণ ও
কর্তৃত্ব নিজের কাছে রাখতে চান কিন্তু নিজেকে পুরোপুরি ইনভলভ করতে চান না। যার ফলে
ছোটখাট কিছু ফাঁক ফোঁকর থেকে ধীরে ধীরে দূরত্ব এতো বেশী হয়ে যায় যে সম্পর্ক নষ্ট
হয়ে যায়! তখন তারা আত্মতৃপ্তিতে ভুগেন যে ভাগ্য ভালো তেমন বেশী ভালোবাসেন নি, না
হলে তো এখন ভীষণ কষ্ট পেতেন!
ভালোবাসা নিয়ে ভালো ভালো উপদেশ দেয়া বা লাভ গুরু হওয়া এই লেখার উদ্দেশ্য নয়।
ভালোবাসতে ভয় পাওয়া –অদ্ভুত এই সমস্যাটিকে আমি অনেক কাছ থেকে দেখেছি, অনেকের মাঝে
দেখেছি। সমরেশ মজুমদারের একটা বই পড়েছিলাম ‘অনেকেই একা’। গল্পটা ভালো লাগেনি
কিন্তু সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং-এর এই যুগে নামটাকে এখন অনেক যথার্থ মনে হয়। ফ্রেন্ড
লিস্টে অনেক অনেক বন্ধু নিয়ে এখন অনেকেই একা! তারা ভালোবাসতে ভয় পান, ভালোবাসা
গ্রহণ করতে ভয় পান, কেউ ভালোবাসলে সন্দেহ প্রকাশ করেন, পিছনে রহস্য কি জানতে চান। সাঁতার
কাটতে নেমে জলে গা না ভেজানোর মতো ভালোবেসে তার কষ্ট পাওয়ার ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে চান।
কিন্তু নিরাপদ আচরণগুলো সাময়িক স্বস্তি দেয় বটে, কোন সমস্যার সমাধান দেয়না। তাই
নিজেকে কষ্ট থেকে বাঁচিয়ে রাখার বা সম্পর্কের কর্তৃত্ব ধরে রাখবার প্রবণতা
সম্পর্কের ভিত্তি দুর্বল করে শুধুমাত্র, এর বেশী কোন কাজে আসেনা। এই মন্তব্য আমার
পর্যবেক্ষণ থেকে করা। আপনাদের যে কোন মতামত জানানোর আমন্ত্রণ রইল।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন