মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭

শিশুর বেড়ে উঠায় পরিবারের ভূমিকা



আমার বাবুর বয়স বছর মাস। সে মোবাইল দেখলেই অনেক উত্তেজিত হয়ে যায়। আমি চাইনা সে খুব বেশি মোবাইলের সংস্পর্শে  আসুক। কারণ মোবাইল স্ক্রীনের আলো যেহেতু বাচ্চাদের চোখের জন্য ক্ষতিকর। কিন্তু এই বিষয়টা পরিবারের অন্য কেউ গুরুত্তের সাথে নিচ্ছেনা। সবাই সব কিছুর সমাধান হিসাবে তার হাতে মোবাইল দিয়ে দেয়। যেমন সে কান্না করলে তাকে থামানোর জন্য, খেলার জন্য, বা কখনো ছবি দেখানোর জন্য। এছাড়াও যারা দূরে থাকেন তারা ভিডিও কল করে দেখে দেখে কথা বলতে চান। তারা সবাই নিজের পরিবারেরই মানুষ। তাই না করাটা কঠিন। আর এখনকার সময়ে যেহেতু মোবাইল ছাড়া কারো একমুহূর্ত চলেনা, সবাই কারণে-অকারণে মোবাইলে মাথা গুঁজে থাকে, বাবুর জন্যও মোবাইলটা খুব কৌতুহলের জিনিস হয়ে উঠেছে। এখন তার হাতে মোবাইল না দিলে সে কাঁদে। কিন্তু আমি চাই মোবাইলের ব্যবহার বেবির জন্য সীমিত হোক। এই বিষয়টা সবাইকে বোঝাতে অনেক বেগ পেতে হচ্ছে। অনেক সময় আমার আড়ালে বাবুর হাতে মোবাইল দিয়ে দিচ্ছেন যা আমাকে আরো বেশি কষ্ট দেয়। কারণ আমি মনে করি এতে করে বাচ্চাটি আমার কাছে আড়াল করতে শিখবে এবং দূরত্ব তৈরি হবে।  আমি এখন কি করব??? “

একটি শিশু জন্ম নেয়ার পর পরিবারের অনেক কিছুই বদলে যায়। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে এক নতুন মাত্রা যোগ হয়। নতুন মায়ের সাথে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সম্পর্কেও এক নতুন সেতুবন্ধন তৈরী হয়। যারা প্রথমবার মা বাবা হন তাদের অনেকেই শিশুকে সঠিকভাবে লালন পালন করা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেন। সেরকম একজন মায়ের কথাই উপরে তুলে ধরা হয়েছে। শিশুকে পরিবারের নিয়ম কানুনগুলো শেখানো, কাংখিত আচরণগুলো গড়ে তোলা, অনাকাংখিত আচরণ যেমন মিথ্যা বলা কিভাবে দূর করা যায় ইত্যাদি অনেক বিষয় নিয়েই বাবা মায়ের অনেক প্রশ্ন থাকে। আমাদের দেশে বাচ্চাকে মানুষ করার ক্ষেত্রে যেহেতু মায়েরাই বেশি সময় দেন তাই উদ্বেগটাও মা্যেদেরই বেশি। আবার বাচ্চাদের কোন ভুল আচরণের জন্য মায়েদেরকেই দোষারোপ করা হয় বেশি যা একদমই সঠিক নয়। একটি শিশু পৃথিবীতে আসার পর তার সবকিছু শেখাই হয় পরিবার থেকে। শিশুর ভালো আচরণ, মন্দ আচরণ সব আচরণের পেছনেই পরিবারের ভূমিকা অসীম। শিশুরা সবকিছুই খুব তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে এবং সেই অনুযায়ী আচরণ করে। যেমন উপরের গল্পের মায়ের আশংকাটি সঠিক। বাচ্চাটি যখনই বুঝতে পারবে তার মা শুধু মোবাইল অ্যালাউ করছে না পরিবারের অন্যেরা করছে তখন সেও মায়ের আড়ালে মোবাইল নিয়ে খেলবে এবং হয়তো মায়ের কাছে তা লুকাতে শিখবে। পরবর্তিতে তা অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রেও হতে পারে। মা যা পছন্দ করে না তা মায়ের আড়ালে করা এবং মায়ের কাছে লুকানো যা হয়তো ছোট ছোট মিথ্যার সূত্রপাত করতে পারে। কারণেই শিশুদের কোন কিছু শেখাতে চাইলে সে বিষয়ে পরিবারের সকলের একই দৃষ্টিভংগী থাকা  এবং সকলেরই সেই কাংখিত আচরণ শিখতে সহায়তা করা দরকার। ভিন্নমত থাকলেও বড়রা তা আলোচনা করে সকলে একমত হতে সেরকম একটি জায়গায় পৌছে সেই লক্ষ্যটিই বাচ্চার জন্য নির্ধারণ করতে হয়
এই বিষয়টাই সবচেয়ে কঠিন। এমনকি প্রফেশনালদের জন্যও। একজন প্রফেশনাল যখন প্রাপ্ত বয়স্ক ক্লায়েন্ট দেখেন তখন তার জন্য কাজটা তুলনামূলকভাবে সহজ কারণ প্রাপ্ত বয়স্ক ব্যাক্তিটি নিজের সমস্যাটি বুঝতে পারেন এবং তা নিজেই সমাধানের দায়িত্ব নিতে পারেন (বিশেষ কিছু ক্ষেত্র ছাড়া ) কিন্তু বাচ্চাদের আচরণগত সমস্যা সমাধানের জন্য যখন বাবা মা বাচ্চাকে নিয়ে আসেন তখন মূলত বাবা মা এবং পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের নিয়েই কাজ করতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাচ্চাদের আচরণগত সমস্যার জন্য পারিবারিক নিয়ম শৃংখলার অভাব, বাবা-মায়ের পর্যাপ্ত সময় না দেয়া, বাবা-মার নিজেদের দাম্পত্য কলহের প্রভাব, শিশুদের যা করতে বলা তা নিজেরা মেনে না চলা, কাংখিত আচরণকে পুরস্কৃত না করে অনাকাংখিত আচরণগুলোর প্রতি অতিরিক্ত মনোযোগ দেয়া ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় দায়ী। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বড়রা যদি তাদের আচরণে পরিবর্তন আনেন শিশুর সমস্যা অনেকাংশেই সমাধান হয়ে যায়। শিশুদেরকে যে পরিবেশ দেয়া হয় তারা সেভাবেই বেড়ে ওঠে।
তাই শিশুদেরকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হলে বাবা মা সহ পরিবারের সকল সদস্যদের যে বিষয়গুলি মাথায় রাখতে হবে তা হলোঃ
           শিশু কি করতে পারবে বা কি করতে পারবে না, কি চাইলে পাবে বা কি চাইলে পাবে না তার জন্য একটা লিমিট সেট করা। অনেক বাবা মা মনে করেন শিশু যা চায় তা দিয়ে দেয়াটাই বুঝি আদর। কিন্তু আসলে তা নয়। শিশুর বয়স বুঝে তার কোন আবদারগুলো পূরণ করা উচিত তা পরিবারের সবাই মিলেই ঠিক করতে হবে। যেন বাবা মা একজন নিষেধ করলেন কিন্তু অন্যজন দিয়ে দিলেন এমন না হয়।
           শাসন বা পারিবারিক নিয়মনীতিগুলো যেন সঠিকভাবে প্রয়োগ করা হয়। একই আচরণের জন্য একদিন কিছুই না বলা বা আরেকদিন কঠিন শাস্তি দেয়া বাচ্চাদের কাছে ভুল মেসেজ পৌছায়। তারা অনাকাংখিত আচরণের সাথে শাস্তির সম্পর্কটা বুঝতে পারে না, তারা মনে বাবা মা তাদের মেজাজ মর্জির উপর নির্ভর করে শিশুদেরকে শাস্তি দেন।
           শিশুদেরকে যে আচরণ নিষেধ করা হয় তা নিজেরাও না করা। যেমনঃ বাচ্চাকে মিথ্যা বলতে নিষেধ করে যদি বাবা মাই বাচ্চার সামনে মিথ্যা বলেন তাহলে স্বাভাবিকভাবেই বাচ্চার ভেতরে কাংখিত আচরণ গড়ে তোলা যাবেনা। বাবা মা যা বলেন তার চেয়ে তারা যা করেন তাই শিশুকে শেখায় সবচেয়ে বেশি।
একটা কেস স্টাডি দিয়ে শুরু করেছিলাম যেখানে একজন মা তার বাচ্চার জন্য মোবাইলের ব্যবহার সীমিত করতে চাচ্ছেন কিন্তু পরিবারের অন্যান্যদের ততটা সহযোগীতা পাচ্ছেন না। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইরকম দৃশ্যই দেখা যায়। কিন্তু আমরা যখন লক্ষ্য স্থির করব শিশুদের জন্য পরিবারে একটা ইতিবাচক পরিবেশ তৈরি করব তখন বাবা মা সহ পরিবারের আমাদের সকলেরই কিছু স্যাক্রিফাইস করতে হবে। আমরা নিজেরা যদি আদর্শ  না হই তাহলে আদর্শ সন্তান কিভাবে গড়ে তুলব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন