ছেলে ও মেয়েতে বন্ধুত্ব হয়
কিনা সেই তর্ক অনেক পুরানো। অনেকে ছেলে মেয়েতে বন্ধুত্ব হয়না, প্রেম হয় বলে বিশ্বাস করেন আবার অনেকে যারা এরকম মনে
করেন তাদেরকে ‘খ্যাত’ মনে করেন। এই দুটো অবস্থান থেকেই আমি একটু নিরাপদ
দূরত্বে থাকতে চাই। বিপরীত লিঙ্গের বন্ধুত্বে বিশ্বাস করি তবে তা খুব ঘনিষ্ঠ বা
নির্ভরশীল বন্ধুত্বে নয়, মাত্রার ভিতরে। এখনকার যুগ হচ্ছে সোশ্যাল নেটওয়ার্কের
যুগ। এখন নাকি প্রতি ঘরে ঘরে বন্ধুর প্রয়োজন হয়! এতো বন্ধু মেইনটেইন করে ছেলেমেয়েরা পড়াশোনা করবে কিভাবে
তা আমার মনে প্রশ্ন তোলে কিন্তু সে আলোচনায় আজকে না যাই। আজকে যে বিষয়টি নিয়ে
আপনাদের সাথে কথা বলতে চাই তা হলো এই যে এতো বন্ধুদের সাথে আসলে কতখানি বন্ধুত্ব
করব, বিশেষ করে বিপরীত লিঙ্গের
সাথে!!
ফেসবুক, স্কাইপ, ওয়াটস অ্যাপ, ভাইবার ইত্যাদি ইত্যাদি বহুবিধ ভার্চুয়াল সামাজিক
নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত। সেখানে আমাদের বিভিন্ন ক্যাটগরির বন্ধু থাকে। বাচ্চা
কালের বন্ধু, স্কুল-কলেজের বন্ধু, কর্মক্ষেত্রের কলিগ (তারাও বন্ধু), আমাদের টিচাররাও আমাদের বন্ধু হবার সুযোগ দিয়ে থাকেন, এছাড়াও এই বিশাল বন্ধু লিস্টের অনেকেই পরিচিত, অল্প পরিচিত, কেউ বা আবার পরিচিতদের পরিচিত আবার কেউ বা যেকোন ফ্রেন্ড
রিকোয়েস্ট পেলেই একসেপ্ট করেন। ফ্রেন্ড লিস্টে ফ্রেন্ডদের সংখ্যা একটা প্রেস্টিজের বিষয়!
ভার্চুয়াল জগতের এই
বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা হয় ‘চ্যাট’ করার মাধ্যমে। আমি লেখা শুরু করেছিলাম ছেলে মেয়েদের
বন্ধুত্ব নিয়ে। অনেকেই নতুন বন্ধুত্ব তৈরী করার জন্য বেছে নেন এই সামাজিক
মাধ্যমগুলোকে। অনেকে আবার পুরানো সম্পর্ককে নতুন করে পুনরুজ্জীবিত করেন। ইদানিং যে
খবরগুলো আমাকে আতংকিত করে তা হলো প্রেমের ফাঁদে পড়ে মেয়েদের সর্বনাশ- ভিডিও সহ। হরেক রকম অনলাইন নিউজ ওয়েবসাইটগুলোতে এগুলোই
এখন রমরমা খবর।
কিন্তু আমার আজকের লেখা
সাইকোপ্যাথদের নিয়ে নয়। যারা পরিকল্পিতভাবে মানুষকে ফাঁদে ফেলে ফায়দা নেয়। আমার
আজকের লেখা তাদের জন্য যাদের কাছে পরিবার, বন্ধুত্বের মূল্যায়ন আছে, জীবনে কিছু
করার বা কিছু হওয়ার স্বপ্ন আছে, সামাজিক, পারিবারিক ও পেশাগত জীবনে সফল হওয়ার
ইচ্ছে আছে। যারা এরকম স্বপ্ন দেখেন সময়টা তাদের খুব একটা অনুকূলে নয়। কারণ এখন
সময়টা যারা হুজুগে তাদের জন্য। এখন সবাই মন যা চায় সেই দিকেই ঝুঁকে পড়ে। কারো
ফেসবুকে সময় কাটাতে ভালো লাগলে সারাদিন ফেসবুকেই কাটিয়ে দিচ্ছে, কারো মোবাইল ফোনে
কথা বলতে ভালো লাগলে সারা রাত কথা বলেই কাটিয়ে দিচ্ছে, কারো আড্ডা দিতে ভালো লাগলে
তার বাসায় ফেরার আর নাম নেই। এর সবকিছুই কিন্তু বন্ধুদের ঘিরে। আর কয়জন ছেলে বা
মেয়ে যারা ফেসবুকে অতিরিক্ত সময় কাটায় বা মোবাইলে কথা বলে সমলিঙ্গের বন্ধুদের
সাথে! তবে এখন যেহেতু সহজে কেউ রোমান্টিক সম্পর্কে জড়াতে চায় না তাই সবাই এখন
বন্ধু। কেউ কেউ হয়তো বন্ধুত্বের সীমাতে ধরে রাখতে পারে কিন্তু বেশীরভাগ ক্ষেত্রেই
যখন কারো সাথে নিয়মিত কথা বলা বা চ্যাট করা হয় তখন একপক্ষ বন্ধুত্ব বা পরিচিতদের
গন্ডি থেকে বের হয়ে আবেগীয়ভাবে নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। তখনই শুরু হয় ভুল বোঝাবুঝি।
অপরপক্ষ থেকে একই রকম সাড়া না পেলে তখন নিজেকে প্রতারিত মনে করে আর অপরপক্ষকে মনে
করে প্রতারক। অথচ হয়তো এই সম্পর্কের সূত্রপাত হয়েছিলো ফেসবুকে অলস সময় কাটানো
‘হাই, হ্যালো, কি করছেন?, কি নিয়ে ব্যস্ত দিয়ে’। তাই আমার আজকের এই লেখা যে
আসলে কতখানি বন্ধু হবো।
এখনকার প্রতিযোগীতামূলক
জীবনে সবাই এতো এতো সামাজিক যোগাযোগের নেটওয়ার্কের ভেতরে থেকেও যেন অনিরাপত্তায়
ভোগে। ভেতরে ভেতরে এতটাই একা, বন্ধুহীন, ভালোবাসার অভাব যেন তাড়া করে ফেরে। অনেক
সময়ই দেখেছি যখন অনেকে খুব বেশী আবেগপ্রবণ থাকে হয়তো বাবা মায়ের ঝগড়া, স্বামী
স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব বা আগের সম্পর্কে ব্রেক আপ বিভিন্ন কারণে তখন তারা সম্পর্কে
বেশী জড়িয়ে পড়ে। অন্য একটি সম্পর্কে জড়িয়ে তারা ওই সমস্যাগুলো ভুলে থাকতে চায় বা
তা থেক মুক্তি পেতে চায়। কিন্তু এই খাপছাড়া সম্পর্কগুলো জীবনে আরো বেশী জটিলতা
তৈরী করে। মানুষকে আরো বেশী বিপর্যস্ত করে।
অনেক সময়ই শুনি “আমি তো
শুধু বন্ধু ভেবেছিলাম, কিন্তু ও যে দুর্বল হয়ে পড়বে বুঝতে পারিনি। আমি তো কাউকে
কষ্ট দিতে চাইনি, এরকম কেন হলো জানিনা”। এই কথাগুলো তাদের মুখ থেকেই শোনা যায় যারা
সম্পর্ককে মূল্যায়ন করেন। দেখা গেল বিয়ের পরেও হাসব্যান্ড ব্যাস্ত, আশানুরূপ সময়
দিতে পারছেন না, হয়তো কোন ক্লাসমেট যার সাথে আগে কিছুই ছিলো না, টুকটাক কথা বলে
সময় কাটাতে গিয়ে নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। কিন্তু সেই ভদ্রমহিলার হয়তো স্বামীকে ঠকানোর
কোন উদ্দেশ্যই ছিল না। অনাকাংখিত পরস্থিতির শিকার।
আবার আমরা অনেকেই যখন কথা
বলি এমনভাবে কথা বলি যেন অন্যদের মনে কিছু একটা আশার সঞ্চার হয় যে, সম্ভাবনা আছে।
মানুষ হিসাবে আমরা সবাই চাই যা সবাই আমাদের পছন্দ করুক। অন্যদেরকে তাক লাগানো,
অন্যদের মনে জায়গা করে নেওয়ার ইচ্ছা আমাদের সবসময়ই করে। কথার চমকে মানুষকে মুগ্ধ
করার চেষ্টাকে আমরা খুব বেশী অন্যায় বলে মনে করিনা। কারণ আমরা শুধু শারীরিকভাবে
অনুপ্রবেশকেই অপরাধ বলে মনে করি। কারো মনে অন্যায়ভাবে আশার সঞ্চার করাও অনুচিত তা
খেয়াল করিনা। যেমন অনেক সময় ছেলেদের ক্ষেত্রে দেখা যায় তারা তাদের ম্যারিটাল স্ট্যাটাস
লুকিয়ে এমনভাবে কারো সাথে আলাপ পরিচয় গড়ে তোলেন যে অপর পক্ষের মনে হয় সম্ভাবনা
আছে।
ফেসবুকে মেসেজের সূত্র ধরে
স্বামী স্ত্রীতে দ্বন্দ্ব এখন অতি সাধারণ ঘটনা। প্রায়শই তা ডিভোর্স পর্যন্ত গড়িয়ে
যাচ্ছে। স্ত্রীদের মতে ছেলেরা ঘরের বাইরে গেলেই বউ আছে যে ভুলে যায়। স্বামীরা বলে
কিছু না করলেও বউরা সন্দেহ করে, ভালো থেকে লাভ কি। উভয়পক্ষকে বলছি প্রথম দেখায়
প্রেম হলেও হতে পারে কিন্তু আস্থা তৈরী হয়না। আস্থা তৈরী প্রতিদিনকার চলনে-বলনে,
আচার-আচরণে। আপনার সঙ্গীর মনে আস্থা আপনাকেই তৈরী করতে হবে। পারিবারিক সম্পর্কের
স্থিরতা মানসিক প্রশান্তি বজায় রাখতে অসম্ভব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
পারিবারিক সম্পর্কগুলোতে যদি আপনি সুখী থাকেন তাহলে সামাজিক ভাবে, কর্মক্ষত্রে
আপনার জয় সুনিশ্চিত। বেশীরভাগ মানসিক সমস্যা, মাদকাসক্তির সমস্যার ক্ষেত্রেই দেখা
যায় পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা, দ্বন্দ্ব, অসুখী থাকা মূল কারণ হিসাবে কাজ করে।
এই সময়ে আমার কথাটা হয়তো
অদ্ভুতই শোনাবে, জীবনটাকে সহজ করতে গেলে আপনার অনেক অনেক বন্ধুর দরকার নেই, কিছু
ঘনিষ্ঠ, সৎ বন্ধুর প্রয়োজন। অনেক অনেক বন্ধু থাকা, অনেক অনেক মেয়ে বন্ধু থাকা,
অনেক অনেক শারীরিক সম্পর্কে জড়ানো ‘COOL’
নয়। সম্পর্ককে মূল্যায়ন করা, একটি সম্পর্কের
প্রতি বিশ্বস্ত থাকাটাই ‘COOL’. কাউকে বিশ্বাস করতে না পারা, একাধিক সম্পর্কের ভাঙ্গন,
একাধক শারীরিক সম্পর্কে জড়া নো মানসিক সমস্যার লক্ষণ!!!
পরিশেষে এটুকুই বলতে চাই
বিপরীত লিঙ্গের সাথে বন্ধুত্বের ক্ষেত্রে খুব বেশী কিছু নয় এটুকু খেয়াল রাখলেই হবে
তা যেন আপনার অন্য কোন সম্পর্ককে ক্ষতিগ্রস্ত না করে, আপনার জীবনসঙ্গীর মনে
ইনসিকিউরিটি তৈরী না করে। সেই বন্ধুত্ব যেন কোন এক পক্ষের জন্য কষ্টের কারণ হয়ে না
দাঁড়ায়।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন