আমাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রতিনিয়তই নানান
ঘটনা ঘটে। সেই ঘটনাগুলোকে আমরা প্রত্যেকেই নিজেদের মতো করে ব্যাখ্যা করি বা
নিজেদের মতো করে বুঝে নেই। পরিস্থিতিগুলো হয়তো এমন হয় যে, আমাদের মনে হয় আমরা যা
চিন্তা করছি তার বিকল্প কিছু হতেই পারেনা। আমি যা ভাবছি তাই ঠিক - আমাকে বোঝানোর
দরকার নেই, এরকমই আমরা মনে করি। আপাতদৃষ্টিতে সঠিক বলে মনে হয় কিন্তু প্রকৃতপক্ষে
নয় এইরকম চিন্তার ধরনগুলোকে মনোবিজ্ঞানের ভাষায় বলা হয় ' distorted cognition’ বা চিন্তনের বিচ্যুতি। জ্ঞানীয় বা চিন্তনের বিচ্যুতি সাধারণত আমাদের মনে
নেতিবাচক প্রভাব তৈরী করে এবং এগুলো স্বাভাবিক চিন্তারই অতিরিক্ত বা অযৌক্তিক
বহিঃপ্রকাশ। যেমন, কেউ হয়তো পরীক্ষায় খারাপ রেজাল্ট করল, সে কারনে মনে করলো ‘আমি
আসলে অপদার্থ, আমাকে দিয়ে কিছুই হবেনা’।
বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে স্বাভাবিক মনে হলেও এখানে ব্যক্তি প্রথমতঃ নিজেকে একটি
মার্কা মেরে দিলো যে আসলে সে অপদার্থ এবং ফলাফল খারাপ করার বিষয়টি সে সবক্ষেত্রে
প্রয়গ করল যে তার দ্বারা কিছুই হবেনা। এ ধরনের চিন্তাগুলোই মানুষের জীবনের
স্বাভাবিক বিকাশের অন্তরায়। যার ফলে মানুষ পদেপদে পিছিয়ে পড়ে। এ রকমই কিছু বিচ্যুত
চিন্তা বা ভুলভাবে বোঝার ধরন মনোবিজ্ঞানের ভাষায় ব্যাখ্যা করা হলোঃ
১। হয় সব নাহলে না, হয় সাদা নয় কালোঃ
এক্ষেত্রে ব্যক্তি যে কোন বিষয়বস্তু, ঘটনা অথবা অন্যদের সম্পর্কে মূল্যায়ন
শুধুমাত্র দুইভাবে করে। যার ফলে প্রেক্ষাপটটির সঠিক মূল্যায়ন সম্ভব হয় না। যেমনঃ
অনেক শিক্ষার্থী মনে করে যদি তারা পরীক্ষায় প্রথম না হয় তাহলে তারা খারাপ ছাত্র,
বা অন্যদের মূল্যায়নের ক্ষেত্রে যদি ব্যক্তিটি ভালো না হয় তাহলে নিশ্চয়ই
খারাপ।কিন্তু পরীক্ষায় প্রথম না হলেই যেমন কেউ খারাপ ছাত্র হয়ে যায়না তেমনি কেউ
ভালো নয় মানেই যে সে খারাপ তাও সঠিক নয়। এ ধরনের বিচুতিতে ব্যাক্তি চিন্তার
ক্ষেত্রে চরমপন্থি হয়।
২। তিলকে তাল করা বা ভাগ্য অনুমান করাঃ
এক্ষেত্রে যে কোন ঘটনাকে বড়ো করে দেখা হয় ঘটনা সম্পর্কে নেতিবাচক ভবিষ্যতবাণী করা
হয়। যেমন কেউ হয়তো কাউকে মনের কথা জানিয়ে সাড়া পেলোনা তখন সে মনে করলো ‘আমাকে আসলে
কেউ ভালোবাসেনা। আমি সারাজীবনই কষ্ট পাবো, এরকম অপমানিত হবো।
৩। নিজের ভালো দিককে গুরুত্ব না দেয়াঃ ব্যক্তি
তার ভালো গুণ, দক্ষতা, কাজ বা অভিজ্ঞতাকে মূল্যায়ন করেনা। এ ধরনের কথাগুলোই তার
উদাহরণ ‘ইংলিশে পেয়েছি আমি ভালো ছাত্র বলে
যে তা না, সেদিন প্রশ্ন সহজ হয়েছিল’ বা ‘ রান্না ভালো করি তো কি হয়েছে এটা তো সবাই
পারে’ ইত্যাদি।
৪। আবেগীয় পক্ষপাতিত্বঃ ব্যক্তি আবেগীয়ভাবে
এমন কোন ধারণার বশবর্তী হয় যা কিনা সত্যি নয় অথবা বাস্তবতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ
নয়। যেমন, অনেকেই অভিযোগ করেন যে ‘কোন কাজ করতে গেলেই মনে হয় আমি পারবনা। আমি আসলে
কোন কাজের না’। অথচ কাজে নামিয়ে দিলে তারা তা ভালোভাবেই সম্পাদন করতে পারে।
৫।মার্কা লাগিয়ে নেয়া বা দেয়াঃ ব্যক্তি
নিজের সম্পর্কে বা অন্যদের সম্পর্কে একটি নির্দিষ্ট মার্কা এঁটে দেয়। যেমন,
অযোগ্য, অপদার্থ, অলস, কুঁড়ে, বাচাল, অমিশুক ইত্যাদি।
৬। উপসংহারে পৌছে যাওয়াঃ যে কোন একটি
বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একেবারে সেই বিষয়ের উপসংহারে পৌছানো। যেমন, ‘ আজকে
যে আমাদের প্রথম দেখা হয়েছিলো তা আমার হাজবেন্ড ভুলেই গেছে। ও আসলে আমকে
ভালোইবাসেনা’।
৭। নির্বাচিত বিষয়ই দেখাঃ ব্যক্তি শুধু সেই
বিষয়ের প্রতি মনোযোগী হয় যা তার মতামতের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ কিন্তু সমগ্র ঘটনাটি
বিবেচনা করে না। যেমন, অংকে পাওয়াটাই প্রমাণ করে যে আমার যোগ্যতা কতটুকু। অংকই তো
আসল বিষয়। আর তাতেই ভালো করি নাই’।
৮। অন্যেরা কি মনে করবে তা বুঝে নেওয়াঃ
এক্ষেত্রে অন্যেরা কি মনে করেছে বা কি মনে করবে ব্যক্তি নিজেই ঠিক করে নেয়। যেমন,
আমি যদি তার কাছে ধার চাই তাহলে আমাকে নিশ্চয়ই আমাকে হ্যাংলা মনে করবে’।
৯। অতিরিক্ত সাধারনীকরণঃ ব্যক্তি যে কোন
একটি ঘটনাকে ধরে ফলাফলকে সবক্ষেত্রেই প্রয়োগ করে। যেমন, ‘ দিবা সেদিন মার্কেটে
আমাকে দেখেও কথা বলেনি, ইচ্ছে করে এড়িয়ে গেছে। সবাই আমাকে এড়িয়ে যেতে চায়। কেউ
আমাকে পছন্দ করেনা।আমার কোথাও না যাওয়াই ভালো।টিচাররাও আমাকে পছন্দ করেনা। যেদিন
পড়া পারিনা সেইদিনই ধরে’।
১০। নিজের উপর নেয়াঃ ব্যক্তি মনে করে সবাই
শুধু তার সাথে খারাপ আচরণ করে বা যে কোন ঘটনার জন্যই নিজেকে দায়ী করে। যেমন, ‘বস
যে মিটিংএ কথাগুলো বলছিলেন আসলে আমাকে উদ্দেশ্য করেই বলছিলেন।কাজটাতো আমার জন্যই
ভালো করে শেষ হয়নি।আমাকে বোঝানোর জন্যই বলেছেন’।
১১। করা উচিত ছিল বা করতেই হবে এমন বিবৃতিঃ যে
কোন বিষয়েই অনেক বেশি রিজিড থাকে। আমার ভালো করা উচিত বা আমাকে ভালো করতেই হবে –
মতামতগুলো এই ধরনের হয়। যার ফলে অনেক বেশী চাপের মধ্যে থাকে এবং প্রত্যাশা পূরণ না
হলে ভেঙ্গে পড়ে।
১২। সংকীর্ণভাবে দেখাঃ যে কোন পরিস্থিতিতে
ব্যক্তি শুধু খারাপ দিকগুলোই দেখে।যেমন, ‘আমার স্ত্রী কোন কাজই ঠিকমতো করতে
পারেনা, না রান্না করতে পারে, না বাচ্চাদের যত্ন নিতে পারে’।
১৩। দোষ অন্যের ঘাড়ে চাপানোঃ ব্যক্তি তার
যাবতীয় সমস্যার জন্য অন্যদেরকে দায়ী মনে করে এবং সে কারণে সেভাবে ক্ষোভ প্রকাশ
করে। যেমন, ‘তোমার কারণে আজকে আমার এই অবস্থা। সবকিছুর পেছনে তুমিই দায়ী’।
১৪। পরিবর্তনের দুরাশাঃ ব্যক্তি আশা করে
অন্যেরা তার চাহিদা অনুযায়ী পরিবর্তিত হবে। তারা অন্যদের পরিবর্তন করতে চায় কারণ
তাদের ভালো থাকার অনুভূতি অন্যদের উপর নির্ভরশীল।যেমন অনেক সময় আমরা আমাদের
পছন্দের মানুষটিকে তার নিজস্বতাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মতো গড়েপিটে নিতে চাই। আর
সেরকম না হলেই হয় মনোমালিন্য।
এই জাতীয় চিন্তনের বিচ্যুতিগুলো আমাদের
স্বাভাবিক জীবনযাপনকে ব্যহত করে, আমাদের সম্পর্কগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করে।এরকম
ভুলভাবে বোঝার পরিমাণ যদি বেশী হয় তাহলে তা মানসিক সমস্যা তৈরী করে। যেমনঃ
বিষন্নতা, সামাজিক উদ্বেগ বা ভীতি প্রভৃতি। সুতরাং আমরা যদি নিজেদের চিন্তাভাবনার
গতিপথগুলোকে যাচাই করে সংশোধিত করে নিতে পারি তাহলে আমাদের জীবন আরো সহজ ও সাবলীল
হয়ে উঠবে।
well-written....
উত্তরমুছুনThanks!
মুছুনexellent writing.
উত্তরমুছুন