কথাটি শোনেনি এমন কাউকে খুজে পাওয়া মুশকিল
হবে! আবার শোনার পর খুব বেশী যে অবিশ্বাস করে তাও নয়! পরিস্থিতি অনুযায়ী আমাদের
বিশ্বাসে তারতম্য ঘটে বটে কিন্তু কথাখানি আমরা সহজেই সবাই মেনে নেই। তবে কিভাবে
বিশ্বাসে লক্ষ্যবস্তু মিলায় সেই প্রক্রিয়াটি অনেকেরই অজানা। এই মনোবৈজ্ঞানিক
প্রক্রিয়াটি আজকে আমরা বোঝার চেষ্টা করব।
অনেক দিন আগে একটি নাটক দেখেছিলাম। একজন
অসুস্থতার জন্য কাজের লোককে বিশেষ জায়গা থেকে পড়া পানি আনতে দিয়েছিলেন। কিন্তু
ফাঁকিবাজ কাজের লোক কলের পানি বোতলে ভরে এনে দিয়েছে। রোগী সেই পানি খেয়েই সুস্থ!!!
কিভাবে ঘটল এই যাদুকরী ঘটনা? ঘরের প্রবীণ একজন মন্তব্য করলেন “আল্লাহ্র উপর
বিশ্বাস রাখলে সবই সম্ভব! আল্লাহ্ চাইলে খালি পানি খায়াই মানুষ ভালো হইতে পারে”।
তা হয়তো হতে পারে। আজকে আমরা সেই বিষয়ে তর্কে যাবনা কিন্তু এর মনোবৈজ্ঞানিক
ব্যাখ্যাটা জানব।
বাংলাদেশে যারা চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানীরা কাজ
করেন তারা মূলত ‘Cognitive Behavior
Therapy(CBT)’ ব্যবহার করেন। যার বাংলা হলো জ্ঞানীয় আচরণ
চিকিৎসাপদ্ধতি। যেহেতু বাংলা এবং ইংরেজিতে কোনই তফাত নেই, দুটাই সমান কঠিন। এই চিকিৎসাপদ্ধতির মূল কথা হলো মানুষের আচরণগুলো তার
চিন্তাভাবনার প্রতিফলন ঘটায়, যদি কারও আচরণগত সমস্যা দেখা যায় তাহলে বুঝতে হবে তার
চিন্তন প্রক্রিয়ায় ত্রুটি আছে। যদি আমরা চিন্তন প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন বা পরিবর্ধন
করতে পারি তাহলে আচরণও বদলে যাবে। তবে এখানে শুধু চিন্তা ও আচরণ এই দুটি উপাদানই
নয় পরিস্থিতি, অনুভূতি ও শারীরিক প্রতিক্রিয়া সহ আরও তিনটি উপাদান রয়েছে।
উপাদানগুলো আমি একটি
চিত্রের মাধ্যমে দেখানোর ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম। যেখানে সবগুলো উপাদান
কিভাবে একে অপরের সাথে জড়িত তীর চিহ্নের মাধ্যমে দেখানো হয়েছিলো। যাই হোক,
কোন
পরিস্থিতিকে আমরা যেভাবে ব্যাখ্যা করি বা চিন্তা করি আমাদের অনুভূতি সেরকমই
হয়,
আমাদের শারীরিক প্রতিক্রিয়াও সেরকম আর আমরা সেভাবেই আচরণ করি। প্রতিটি
উপাদানই একে
অপরকে প্রভাবিত করে। আমরা যদি একটু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করি। যেমন আপনি কোন অনুষ্ঠানে নতুন কারো সাথে পরিচিত হলেন যে আপনার সাথে ভাল করে কথা বলল না – এই পরিস্থিতিকে আপনি কয়েকভাবেই দেখতে পারেন। যদি আপনি মনে করেন
“লোকটা অভদ্র, ভালো করে কথাই বলল না” তাহলে আপনি হয়তো বিরক্ত হতে পারেন; যদি আপনি
মনে করেন “ভদ্রলোক হয়তো আমাকে পছন্দ করেনি, আমিতো সবাইকে বোর করে ফেলি” তাহলে হয়তো
আপনার মন খারাপ হবে, যদি আপনি মনে করেন “লোকটা লাজুক টাইপের, মেয়েদের সাথে কথা
বলতে লজ্জা পায়” তাহলে হয়তো আপনি তার জন্য একটু মায়া অনুভব করবেন। তাহলে দেখা
যাচ্ছে একই পরিস্থিতিকে আপনি যেভাবে চিন্তা করবেন আপনার অনুভূতি সেভাবেই তৈরী
হচ্ছে। অনুভূতির সাথে শারীরিক প্রতিক্রিয়ারও সম্পর্ক সামঞ্জস্যপূর্ণ। আপনার মন
খারাপ হলে শরীর নিস্তেজ লাগে, মনে হয় চলতে চায়না; আনন্দে থাকলে নিজেকে হাল্কা,
ফুরফুরে লাগে; উত্তেজিত থাকলে শরীর টানটান থাকে; ভয় পেলে অতিরিক্ত সতর্ক থাকে।
এইরকম প্রতিটি অনুভূতির সাথেই আমাদের শরীরের ভাষা পরিবর্তিত হয়ে যায়। শুধু
অনুভূতিই নয় চিন্তার সাথেও আমাদের শরীরের প্রতিক্রিয়ার গভীর সম্পর্ক রয়েছে। যার
সহজ উদাহরণ হিসাবে বলা যায় যৌন চিন্তা করলে মানুষ যৌন উত্তেজনা বোধ করে। সবশেষের
উপাদানটি হলো আচরণ। যা কিনা আগের সবগুলো উপাদানের সাথেই সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে
সম্পর্কীত। যেমনঃ আগের উদাহরণ অনুযায়ী আপনি যদি মনে করেন লোকটি অভদ্র আর তার প্রতি
বিরক্ত বোধ করেন তাহলে হয়তো পরেরবার দেখা হলে আপনি নিজেই তাকে উপেক্ষা করবেন। যদি
আপনি সবাইকে বোর করেন মনে করে মন খারাপ করেন তাহলে হয়তো পরেরবার কারো সাথে পরিচিত
হতে চাইবেন না বা সেরকম অনুষ্ঠানেই যেতে চাইবেন না। আর যদি আপনি মনে করেন লোকটি
মেয়েদের সাথে কথা বলতে অতিরিক্ত লজ্জা পায় তাহলে হয়তো আপনি তার সাথে নিজ উদ্যোগে
কথা বলে তার অস্বস্তি কমিয়ে দিতে চাইবেন। আপনার আচরণ আবার আপনার পরিস্থিতির
পরিবর্তন ঘটিয়ে দিবে। মজার না?
আমি বলেছিলাম বিশ্বাস কিভাবে লক্ষ্যবস্তু
অর্জনে সহায়তা করে তার মনোবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাটা আলোচনা করব। তাহলে দেখা যাচ্ছে
একজন মানুষ যখন নিজের প্রতি বিশ্বাস রাখে তখন তার মনোভাব স্বাভাবিকভাবেই ইতিবাচক
হয় আচরণগুলোও নির্দিষ্ট লক্ষ্য অনুযায়ী হয় তাই লক্ষ্য অর্জনও সহজ হয়। পজিটিভ
চিন্তা করুন- এমন উপদেশ বা টিপস আমরা অহরহই শুনি। অনেক সফল ব্যাক্তির জীবনী পড়ে বা
কথা শুনে দেখি তারা জীবন সম্পর্কে স্বভাবজাতই ইতিবাচক। কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ
মানুষদের প্রতিদিন নতুন নতুন চ্যালেঞ্জে, নতুন নতুন ব্যার্থতায় বা ব্যার্থতার ভয়ে
ইতিবাচক চিন্তা ধরে রাখা কতখানি কঠিন তা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝতে পারি! তবুও
দিন শেষে যদি কিছু ছোটখাট প্রাপ্তিকেও মূল্যায়ন করতে পারি, নিজের উপর বিশ্বাস রাখতে পারি এবং পরের দিনটিকে নতুন
সম্ভাবনার দিন হিসাবে শুরু করতে পারি সেটুকুই সার্থকতা!