সোমবার, ১৮ মার্চ, ২০১৩

সেলফ হিপ্নোসিসঃ কিভাবে করবেন

সেলহ হিপ্নোসিস কি এবং এর উপকারীতাগুলো কি কি সে বিষয়ে আগের লেখাতেই তুলে ধরেছিলাম। সেলফ হিপ্নোসিস কিভাবে করতে হয় তা লিখব কথা দিয়ে শেষ করেছিলাম। কথা দিয়ে কিছুটা বিপদে গেছি। আমি হিপ্নোসিসে অভিজ্ঞ কেউ বা হিপ্নোথেরাপিষ্ট নই, আপনাদের মতোই হিপ্নোসিসে কৌতুহলী একজন। তবে কৌতুহল নিবৃত্তে পড়াশোনা করছি। সেলফ হিপ্নোসিস করার পদ্ধতি ভালো করে পড়লাম, ভাবলাম প্রয়োগ না করে তো আর কাউকে করতে বলা যায়না, তাই একটু দেরী হয়ে গেলো। যাদের আগ্রহ আমার লেখার ইচ্ছেটা ধরে রাখতে সাহায্য করেছে তাদেরকে ধন্যবাদ।

হিপ্নোথেরাপিষ্ট Tig Calvert এর মতে সেলফ হিপ্নোসিস শেখা খুবই সহজ এবং এটি একটি উপভোগ্য অভিজ্ঞতা। যারা আগ্রহী এবং নিয়মিত অনুশীলন করে তারা সহজেই সেলফ হিপ্নোসিসে দক্ষ হতে পারবে।
হিপ্নোসিস অনুশীলন করার জন্য বেশীরভাগ মানুষই একটু নিরিবিলি জায়গা পছন্দ করে। আরাম করে চেয়ারে বসে বা শুয়ে যে কোনভাবে করতে পারেন। তবে প্রথমদিকে শুয়ে করতে গেলে ঘুমিয়ে পড়বার সম্ভাবনা থাকে। যাদের ঘুমের সমস্যা আছে তারা ঘুমের আগে শুয়েও অনুশীলন করতে পারেন।

হিপ্নোসিসে যে দক্ষতাগুলো কাজে লাগানো হয় তা হচ্ছে কল্পনা করা ও কল্পনায় ছবি তৈরী করা (Imagery and Visualization). অনেকে হয়তো ভয় পান তাদের কল্পনাশক্তি ততটা ভালো নয় কিন্তু হিপ্নোসিসে তা নিয়ে দুঃশ্চিন্তার কিছু নেই। যতটুকু স্বাভাবিকভাবে আসে ততটুকুই যথেষ্ট এবং অনুশীলনের মাধ্যমে তা বৃদ্ধি পাবে। সেলফ হিপ্নোসিসে যাওয়ার প্রক্রিয়ার কিছু ধাপ রয়েছে। যেমনঃ-
           ১। প্রথমে নিজের মনের অসচেতন অবস্থার সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন। যেমনঃ আরাম করে বসে বা শুয়ে চোখ বন্ধ করে নিজের প্রতি মনযোগ নিবদ্ধ করা। আরামদায়ক একটি অবস্থান তৈরী করা।
           ২। আনন্দাশ্রম তৈরী করা (the pleasant place):  আনন্দাশ্রম শব্দটি একটু কাব্যিক হয়ে গেলেও মোদ্দা কথা হচ্ছে আপনাকে আপনার পছন্দের একটি জায়গা কল্পনায় তৈরী করে নিতে হবে। যেখানে আপনি সবসময়ই নিরাপদ বোধ করেন।
           ৩। হিপ্নোসিসে প্রবেশের পদ্ধতি ব্যাবহারঃ হিপ্নোসিসে প্রবেশের অনেকগুলো পদ্ধতি আছে। যেমনঃ শারীরবৃত্তীয় ফিডব্যাক পাওয়ার মাধ্যমে(physiological feedback techniques), সংবেদী মাধ্যমে( sensory techniques), শ্বাস প্রশ্বাসের মাধ্যমে(breathing techniques), চোখ নিবদ্ধকরণের মাধ্যমে (eye fixation techniques) ইত্যাদি।
            ৪। লক্ষ্য ঠিক করে নেয়াঃ হিপ্নোসিসের মাধ্যমে আপনি কোন কোন বিষয় গুলো নিয়ে কাজ করতে চান তা ঠিক করে নিতে হবে।

এখানে সংবেদীয় পদ্ধতির একটি স্ক্রিপ্ট বোঝার সুবিধার্থে তুলে ধরা হল

আমি নিজেকে আরামদায়ক অবস্থানে রাখি এবং নরম করে চোখ বন্ধ করি.........আমি আমার শরীরের অনুভূতির দিকে মনোযোগ দেই এবং সব দুঃশ্চিন্তাগুলাকে ছেড়ে দেই.........নিজের শ্বাস প্রশ্বাসের দিকে মনোযোগী হই.........খুব স্বাভাবিকভাবে.........আমি খেয়াল করি আমার শ্বাস প্রশ্বাস ধীরে ধীরে গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে.........প্রতিটি শ্বাস গ্রহণে আমি শিথিল অনুভব করছি.........আমি আমার কল্পনাকে কাজে লাগিয়ে আরো শিথিল আরামদায়ক অবস্থানে নিয়ে যেতে পারি.........আমি কল্পনা শুরু করি.........যেন গ্রামের পথ দিয়ে হেটে যাচ্ছি.........পথে পথে হাটতে হাটতে বিশাল একটি দরজা দেখতে পাচ্ছি.........দরজার ওপাশে বিশাল মাঠ......... আমি দজা খুলে মাঠে প্রবেশ করছি.........আমি মাঠের চারপাশে ঘুরে ঘুরে দেখছি.........মাঠের সবুজ গালিচার মতো ঘাস দেখছি............মৃদুমন্দ বাতাস আমার শরীরে বুলিয়ে যাচ্ছে............আমি আকাশের দিকে দেখছি.........আকাশের রঙ দেখছি.........পরিস্কার নীল আকাশ.........মাঝে মাঝে কিছু সাদা মেঘের ভেলা......আমি মাঠের মাঝে বিশাল একটা বেলুন দেখতে পেলাম যেগুলো মানুষ বহন করে.........আমি ধীরে ধীরে সেই বেলুনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি.........কাছে গিয়ে দেখি বেলুনের মানুষ বহনের ঝুড়িটি মাটির সাথে লাগানো এবং বেলুন থেকে আগুনের স্ফুলিংগ ছড়িয়ে পড়ছে যে ন তা আকাশে ওড়ার জন্য প্রস্তুত.........খুবই চমৎকার একটি দৃশ্য.........আমি বেলুনের এই ঝুড়িটিতে বসে উত্তেজনাকর একটি ভ্রমণে অংশ নিতে পারি.........আমি ঝুড়িটিতে উঠে বসছি......ঝুড়িটির ভেতরটা খুবই আরামদায়ক.........বসার ব্যবস্থা চমতকার......নিজেকে নিরাপদ অনুভব করছি......বেলুনটি ধীরে ধীরে উপরে উঠতে শুরু কররেছে......আমি বেলুনটিকে মাটি থেকে উপরে উঠতে দেখছি......গরম বাতাস অনুভব করছি.........ধীরে ধীরে উপরে উঠে যাচ্ছি......পৃথিবীর সকল কোলাহল ও ঝুট ঝামেলা থেকে দূরে......সুদূর নীলাকাশে.........আমি আমার শ্বাস প্রশ্বাস খেয়াল করছি......খুব স্বাভাবিকভাবে শ্বাস নিচ্ছি ও ছাড়ছি.........প্রতিটি শ্বাস গ্রহণের সাথেসাথে বেলুনটি আরো উপরে উঠে যাচ্ছে......আরামদায়কভাবে আরো উপরে উঠে যাচ্ছে.........প্রতিটি নিঃশ্বাস ত্যাগের মাধ্যমে আমি আমার সকল দুঃশ্চিন্তা মুক্ত হচ্ছি.........নিজেকে অনুভব ও উপভোগ করার সুযোগ দিচ্ছি.........বেলুনটি আরো উপরে উঠে যাচ্ছে, আরো উঁচুতে, আরো  উঁচুতে.........আর নিজেকে আরো হালকা অনুভব করছি, আরো হালকা............আমার সারা শরীর ভাসছে............আমি বেলুনটিকে যত খুশী উপরে নিয়ে যেতে পারি.........আকাশের সবচেয়ে উঁচুতে .........আমি নিচের দিকে তাকিয়ে ঘরবাড়ীগুলো, রাস্তাগুলো, মাঠ, নদী সব দেখতে পাচ্ছি.........নিজেকে হালকা অনুভব করছি.........  আমার কল্পনাই আমাকে এই ভ্রমণে নিয়ে যাচ্ছে.........এবং নিজেকে হালকা এবং স্বাধীন অনুভব করছি............আমি যেখানে খুশী যেতে পারি .........আমার সেই বিশেষ আনন্দের জায়গাটিতেও.........আমার আনন্দাশ্রমে.........

তাহলে এইবার আপনিও হিপ্নোসিস অনুশীলন করে দেখতে পারেন। তবে প্রশ্ন একটি রয়েই যাচ্ছে। হিপ্নোসিস যে হলো আপনি বুঝবেন কি করে? হিপ্নোসিস অবস্থায় বেশ কিছু পরিবর্তন দেখা যায়। যেমনঃ

১। চোখের পাতা কাঁপা এবং চোখ দ্রুত নড়াচড়া করা
২।শ্বাস প্রশ্বাসের হার পরিবর্তন হওয়া সাধারণত ধীরে ধীরে এবং গভীরভাবে নিঃশ্বাস হওয়া
৩। অনিয়ণত্রিতভাবে মাংশপেশীর কাঁপুনি দেখা যায়
৪।অংগপ্রত্যংগ বেশ ভারী অনুভব করা বা খুব হালকা অনুভব করা। ব্যাক্তিভেদে অভিজ্ঞতা ভিন্ন হতে পারে।
৫।বসে অনুশীলন করলে মাথাটা নুয়ে পড়া, মুখভঙ্গি শিথিল হয়ে যাওয়া, হাল্কা নাক ডাকা, নড়াচড়া করতে না পারা, চোখ দিয়ে পানি পড়া, পেটের ভিত সুড়সুড়ি দেওয়া, শরীরে চুলকানী অনুভব করা, হার্টবিট জোরে জোরে শুনতে পাওয়া
৬।অন্য সময়ে যে শব্দগুলোকে আলাদাভাবে শোনা যেতনা সেগুলো জোরে শুনতে পাওয়া। যেমনঃ ঘড়ির টিক টিক
৭।সময় সম্পর্কে ভুল ধারণা লাভ। যেমন কয়েক মিনিটকে ঘন্টার মতো মনে হওয়া
৮।ক্ষুধা, তৃষ্ণা লোপ পাওয়া, চোখ খুলতে না পারা
৯। উদ্বেগ কমে যাওয়া, শারীরিকভাবে বিচ্ছিন্নতা অনুভব করা
১০। আনন্দের স্মৃতিগুলো স্বতঃস্ফুর্তভাবে মনে পড়া, নিজেকে সুখী অনুভব করা ইত্যাদি।

সবাই যে সবগুলো অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়েই যাবেন তা নয়। প্রত্যেকের অভিজ্ঞতাই ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে।

কিছুটা প্রত্যাশার চাপ নিয়েই লেখাটা লিখতে বসেছিলাম। জানিনা কতটুকু সহজভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছি। আমি নিজেও অনুশীলন করছি, আপনাদের করো কাজে লাগলে ভালো লাগবে। 

১০টি মন্তব্য:

  1. উত্তরগুলি
    1. মেডিটেশনের সাথে হিপ্নোসিসের পার্থক্যটা হলো মেডিটেশনে মাথা থেকে সকল দুঃশ্চিন্তা দূর করতে বলা হয়, যা কিনা অনেকের কাছেই কঠিন মনে হয় কিন্তু হিপ্নোসিসে স্বাভাবিকভাবে যা আসে তার সবকিছুকেই গ্রহণ করা হয় যা তুলনামূলকভাবে সহজ।

      মুছুন
    2. সব কিছুকে স্বাভাবিক ভাবে আসতে দিলে কী মনের উপর নেতিবাচক কোন প্রভাব পড়বেনা?

      মুছুন
  2. Apu,onek valo laglo apnar lekhata pore.hypnosis somporke khub sohoje dharona pelam..thank you apu.

    উত্তরমুছুন
    উত্তরগুলি
    1. এই মন্তব্যটি লেখক দ্বারা সরানো হয়েছে।

      মুছুন
    2. আপনার ভালো লেগেছে জেনে ভালো লাগলো। আসলে ফিডব্যাক না পেলে কেমন হচ্ছে বোঝা যায়না। অনেক ধন্যবাদ।

      মুছুন
  3. khub bhalo laglo jante pere. try to practice. self hypnosis to motamuti janlam, ebar onno k kibhabe hypnotize korbo? a bepare next article er jonno wait korsi. bhalo thakben.

    উত্তরমুছুন
  4. apu khub valo legechhe eta jante pere je self hypnosis ta ki....r ami kortam tobe na jene....ekhon aro beshi kore korbo....thankyou...

    উত্তরমুছুন
  5. কী অসাধারন, সেল্ফ হিপ্নোসিস করতে গিয়ে আমার চোখে পানি চলে এসেছে। কী অবাক করা কান্ড!

    উত্তরমুছুন